গৌরনদী
জীবন যুদ্ধে জয়ী গৌরনদীর শ্রেষ্ঠ পাঁচ নারীর সাফল্য গাঁথা সংগ্রামী জীবন সমাজের দৃষ্ঠান্ত
প্রতিবেদক প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার অসহায় হতদরিদ্র পাঁচ নারী জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, কঠোর পরিশ্রম ও দারিদ্ররতার সঙ্গে যুদ্ধে করে সমাজে আজ তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থনৈতিক সাফল্য, শিক্ষা ও চাকুরী সাফল্য, সফল জননী, নির্যাতন ও বিভীষিকা মুছে এগিয়ে যাওয়ার সাফল্য ও সমাজ উন্নয়নে অসামন্য অবদান রাখায় সমাজের দৃষ্ঠান্তসৃষ্টিকারী ওই পাঁচ নারীরা হলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পিংলাকাঠী গ্রামের রুহুল আমিনের স্ত্রী নাজমা বেগম ( অর্থনৈতিক সফল) তিখাসার গ্রামের রনজিত দেবনাথের কন্যা মনিকা দেবনাথ (শিক্ষা ও চাকুরী), সুন্দরদী গ্রামের কৃঞ্চ পালের কন্যা সবিতা কুÐ (সফল জননী), তিখাসার গ্রামের মৃত জৈনদ্দিন খলিফার কন্যা পরভীন আক্তার (নির্যাতন ও বিভীষিকা মুছে ফেলে স্বপ্ন পুরন) ও মাহিলাড়া গ্রামের মৃত নগেন চন্দ্র করের কন্যা নমিতা মিস্ত্রী (সমাজ উন্নয়ন)। উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে ৫ জয়িতা নারীকে সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে সম্মননা ক্রেষ্ট, সনদ প্রদান করা হয়।
স্থানীয় লোকজন, গৌরনদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খালেদা খানমসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে জীবন সংগ্রামে জয়ী পাঁচ নারীর জীবন সংগ্রামের চিত্র। নাজমা বেগম ঃ ৫ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে নাজমা বেগম ছিলেন ছোট সন্তান। পিতা একজন দরিদ্র কৃষক ছিল। নাজমা বেগম জন্মগত ভাবে হিন্দু ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলিম পরিবারের মোঃ রুহুল আমিন হাওলাদারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলিম হওয়ায় তার শ^শুর শ^াশুরী তাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়নি। যে কারনে সে তার স্বামীকে নিয়ে খুব সমস্যায় পরে যান। বিবাহের সময় তার স্বামী বেকার ছিলেন তখন তিনি তার ব্যহার্য স্বর্ণের গহনা বিক্রি করে বসবাসের জন্য ছোট একটি খরের ঘর করেন। তার স্বামী দিন মজুরের কাজ করত কিন্তু মাঝে মধ্যে কাজ থাকত না। ফলে মাসের অর্ধেক সময় বেকার থাকতেন। যার কারনে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসার চালানো ছিল একেবারেই অসম্ভব। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটত। তাই নাজমা নিজে জমিতে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি এনজিও থেকে কিছু টাকা লোন নিয়ে হাঁস-মুরগী ক্রয় করে পালন শুরু করেন। হাঁস-মুরগীর অগ্রযাত্রাকে পুজি করে তিনি আজ সাবলম্ভি। একের পর এক পানের বরজ, মৎস্য চাষ, গবাধী পশু পালন করে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জন করেছেন। তার তিন সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। বড় ছেলে অর্নাস পাস করেছে, ছোট ছেলে ডিগ্রিতে এবং ছোট মেয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। বর্তমানে তার ৫ টি মাছের খামাড়, একটি মুরগীর ফার্ম ও কিছু পানের বড়জ সহ অনেক জমির মালিক হয়েছেন। তিনি এখন সাবলম্বি নারী। তার বাড়িতে জীর্নশীর্ন খরের ঘরের পরিবর্তে পাকা ভবনে মাথা গোঁজার ঠাই হয়েছে। নাজমা আজ এলাকার দৃষ্ঠান্ত ও অনুসরনীয় নারী।
মনিকা দেবনাথ ঃ মনিকা দেবনাথ ১৯৮৭ সালে ১৫ অক্টোবর এক হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার জন্মের ৬ মাসের সময় তার পিতাকে তথাকথিত সন্ত্রাসী বাহিনীরা অপহরণ করে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে মনিকা দেবনাথের মা সবকিছু হারিয়ে শিশু মনিকাকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে চলে আসেন। মনিকা দেবনাথের মামার বাড়ির আর্থিক অবস্থা তেমন একটা সচ্ছল ছিল না। বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে তার মা তাকে লালন-পলন করে লেখাপড়া শিখিয়ে এম. এ পাশ করিয়েছেন। তিনি পড়াশুনার পাশা পাশি সঙ্গিত চর্চা করেন ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক শাক সবজির চাষ ট্রেডে, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক দর্জি বিজ্ঞান, আনসার ভিডিপি মৌলিক প্রশিক্ষণ, জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপারেশন এজেন্সি (জেআইসিএ) বাংলাদেশ অফিস কর্তৃক শিক্ষাকতার, বাংলাদেশ স্কাউট বরিশাল অঞ্চল থেকে ওরিয়েন্টেশন কোর্স, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক গণিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি তার প্রশিক্ষাণলদ্ধ জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছেন। বর্তমানে ৩১ নং উত্তর পালরদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে দক্ষতার সাথে চাকুরি করতেছেন। মনিকা দেবনাথ সংগ্রাম আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমাজে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
সবিতা কুÐ ঃ হত দরিদ্র পরিবারের ৩ ভাই ও ৭ বোনের মধ্যে সবিতা কুÐ ছিলেন ৩য় সন্তান। পিতার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় ১৯৭৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তার বিবাহ উত্তর জীবনে ২ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। বিয়ের ১৪ বছর পার না হতেই ১৯৯২ সালে স্বামীকে হারান । তখন তার বয়স মাত্র ২৯ বছর। ছেলে মেয়ারা সবাই ছোট এবং পড়াশুনা করে। পরে তিনি অনেক কঠোর পরিশ্রম করে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখান। বড় মেয়ে শিপ্রা রানী কুন্ডু ¯œাতোকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক, সিটিজেনশিপ অর্জনপূর্বক কানাডায় উচ্চ পদে চাকুরী করে। বড় ছেলে জনাব উজ্জ্বল কুমার কুন্ডু এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মসংস্থান ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। ২য় মেয়ে সাথী রানী কুন্ডু বাংলা সাহিত্য বিষয়ে ¯œাতক পাস করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ও সুইডেন দ্বৈত নাগরিক ও সিটিজেনশিপ অর্জনপুর্বক সুইডেনে কর্মরত। ২য় ছেলে জনাব আকাশ কুমার কুন্ডু। ২০১৭ সালে ৩৫ তম বিসিএস এ মেধা তালিকায় ৪০ তম হিসেবে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট হিসেবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জামালপুর এ কর্মরত আছেন। বর্তমানে সবিতা কুন্ডুর পুত্র ও কন্যাদ্বয় দেশ ও বিদেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত হয়ে দেশ ও দশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলকরণ ও রেমিটেন্স প্রেরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করেছেন। স্বামীর অবর্তমানে বৈধব্য জীবন নিয়ে সন্তানদের এই সকল সাফল্য ও অর্জনের পিছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন।
পারভীন আক্তার ঃ দরিদ্র পিতার ৩ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে পারভীন আক্তার। একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুতে তার বাবা শোকাহত হয়ে বিছানায় পড়ে যান। সে সময় তাকে ডাক্তার দেখানোর নাম করে তার বড় বোনের স্বামী কৌশলে তার কাছ থেকে সমস্ত জমি নিজের নামে লিখে নেন। ৩ বছর চিকিৎসা শেষে বাবা মারা যান। তখন পারভীনের বয়স ছিল ১০ বছর। বড় বোনেরা তাদের কোন খোজ নিত না। পারভীন মাকে নিয়ে বিড়ি বেধে যে অর্থ পেতেন তা দিয়ে কোনো ভাবে জীবন চালাতেন। ১৫ বছর বয়সে ১২ সদস্যের একটা বড় পরিবারে পারভীনের বিবাহ হয়। স্বামী মোঃ কামাল সরদার ছিলেন একজন রিক্সা চালক। অভাবের সংসার শশুর-শাশুরী প্রতিনিয়ত নির্যাতন করত। এরই মধ্যে কোল জুরে এলো দুই সন্তান। তখন সে তার স্বামীকে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। ঢাকা যাওয়ার কিছুদিন পর তার স্বামী কাজের কথা বলে যশোরে চলে যান এবং সেখানে বিয়ে করে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঘর বাধেন। পরবর্তিতে পারভীন সন্তানদের নিয়ে বাড়িতে মায়ের কাছে চলে আসেন। তারপর ব্রাক থেকে ৫০০০/- টাকা ঋণ করে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল পালন । এভাবে জীবন যুদ্ধে লড়াই করে দূর্বিসহ জীবন মুছেফেলে নতুন জীবনে ফিরে আসেন। বর্তমানে পারভীন সমাজের অন্য দশ জনের মতো জীবন যাপন করছেন। নিজের পরিচয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন।
নমিতা মিস্ত্রী ঃ ৪ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় নমিতা মিস্ত্রী। বাবা ছিলেন কৃষক। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় লেখাপড়া না করিয়ে অল্প বয়সে বিবাহ দেন। ৪ মেয়ে ১ ছেলেকে নাবালক রেখে ১৯৯৮ সালে স্বামী মারা যায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর বড় মেয়েকে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেন। অন্য ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন এবং তারা ভালো চাকুরী করেন। নমিতা মিস্ত্রী ছোটবেলা থেকে সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। গ্রামের হিন্দু ধর্মালম্বিদের উপসনার জন্য নিজের পাঁচ শতাংশ জমি দান করে দূর্গা মন্দির ও কালি মন্দিও করে দিয়েছেন। মন্দিরের সমস্ত খরচ তিনি নিজেই বহন করছেন। এছারাও গ্রামের জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে নিজের উদ্দ্যেগে রাস্তা করে দিয়েছেন। তিনি বাল্য বিবাহ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সহ সরকারি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে সক্রিয় ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।