সারাদেশ
উজিরপুরে শীতকালীন সবজি চাষে লাভবান কৃষক
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে অধিকসহ ৯টি ইউনিয়নে প্রায় ২০ হাজার কৃষক সবজি চাষ করে অধিক লাভবান হয়েছেন। ফলে ক্ষুদ্র কৃষকসহ স্বল্প জমির মালিকরা সবজী চাষে দিন দিন মনোযোগী হচ্ছেন। চলতি শীত মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩শ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন, কৃষক, সুবিধাভোগী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালের বিভাগীয় সদরসহ গৌরনদী, উজিরপুর, বানরীপাড়া, আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ ও আশপাশের অনেক জেলার সবজি ব্যবসায়ীরা এলাকার চাহিদা পুরন করতে যশোর থেকে সবজি এনে পাইকারি বিক্রি করত। এ অঞ্চলের মানুষকে একমাত্র যশোর থেকে অমদানি করা সবজির উপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু বর্তমানে উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া, জল্লা, বামরাইল, হারতাসহ উজিরপুরের উৎপাদিত সবজি পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ায় স্থানীয় সবজি দিয়ে চাহিদা পুরন হচ্ছে। গত ৭/৮ বছর আগে বিশেষ করে গুঠিয়া ইউনিয়নে কিছু কিছু কৃষক সবজি চাষ শুরু করেন। তারা লাভবান হওয়ায় তাদের অনুসরন করে গুঠিয়ার অধিকাংশ কৃষকই সবজি চাষে নামেন। তারা সবজি চাষে নির্বর করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ধীরে ধীরে গুঠিয়া ইউনিয়ননের প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক সবজি চাষে ঝুকে পড়েন। তাদের লাভবান হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে উজিরপুরের জল্লা, হারতা ও বামরাইলসহ ৯টি ইউনিয়নের সবজি চাষ ছড়িয়ে পরে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া, জল্লা, হারতা ও বামরাইলসহ ৯টি ইউনিয়নে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮ শত ৪০ হেক্টর। যা থেকে নবজি উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হয় ১৭ হাজার ৮’শ মেট্রিক টন । কিন্তু চলতি শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ১২শত হেক্টর জমিতে। প্রতি একরে সবজি চাষে কৃষক ৩৫/৪০ হাজার টাকা উপার্জন করেন।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবজিখ্যাত গুঠিয়া, বামরাইল, জল্লা ও হারতা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মাঠজুড়ে দেখা গেছে শীতকালীন সবজির সমারোহ। তার মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, শিম, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, পালং ও লাল শাক, লাউসহ নানা জাতের সবজি। সবজি ক্ষেতের সৌন্দার্য্য যেন মন কেড়ে নেয়। জমিতে সবজি চাষ ছাড়াও অনেকেরই বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ করতে দেখা গেছে। এসময় সবজি চাষী দেলোয়ার হোসেন, আকরাম আলী, হাকিম হাওলাদারসহ অনেকই জানান, গুঠিয়াসহ উজিরপুরের সবজি এলাকার ও আন্তঃজেলার চাহিদা পুরন করেও বর্তমানে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। শীতকালীন সবজিতে পোঁকা বা রোগের আক্রমণ হলে স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে কৃষকরা অভিযোগ করেন।
উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের ডহরপাড়া গ্রামের সবজি চাষি মনির হোসেন জানান, তিনি গত ৫ বছর আগে নিজের ১০ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ শুরু করেন। এতে ভাল লাভবান হওয়ায় তার সবজি চাষে আগ্রহ বেড়ে যায়। পরবর্তিতে আশ পাশ থেকে জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করে সফল হওয়ার পরে ধীরে ধীরে নিজে জমি ক্রয় করে সবজি চাষ স্বাবলম্বি হয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমি ২ একর জমিতে সকল ধরনের সবজি চাষ করছি। তার মধ্যে দেড় একর জমিতে বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, শালগম, পালং শাক চাষ রয়েছে। কীটনাশক প্রয়োগ না করায় উৎপাদিত এসব সবজির চাহিদাও রয়েছে বেশ। তবে পোঁকা ও রোগের আক্রমনে কিছু সবজি নষ্ট হয়েছে। তারপরেও এ বছর আমি লক্ষাধিক টাকার লাভ করেছি। এখনো ক্ষেতে সবজি রয়েছে । চাষী সালাম শেখ বলেন, আমি সিম চাষে ১৫ হাজার টাকা ব্যায় করেছি। এ বছর প্রতিমন ৮শ টাকা দরে ১৫০ মন সিম বিক্রি করে ১লাখ ২০ হাজার টাকা ঘরে নিছি। আ. কাদের বলেন, ৫ হাজার টাকা সবজি ক্ষেতে ব্যয়ে করে ৪৫ হ্জার টাকা বিক্রি করেছি এখনো ক্ষেতে যা আছে তা ২৫/৩০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবো। একই গ্রামের সবজি চাষি মোঃ ফিরোজ হাওলাদার জানান, শীতকালীন সবজি চাষে খরচ কম লাভ বেশী, সবজি চাষ করে বেশী লাভসহ সহজেই স্ববলম্বী হওয়া যায়। এবার তিনি ৫০ শতক জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ করেছে। বামরাইল ইউনিয়নের দক্ষিন মোড়াকাঠী গ্রামের শীতকালীন সবজি সীম চাষী নুরুল হক রাঢ়ী বলেন, সাত থেকে আট বছর ধরে আমি সীম চাষ করছি। এ বছর ৬০ শতাংশ জমিতে সীমের চাষ ভালই লাভবান হয়েছি। একই ভাবে সবজি চাষ করে লাভবান হওয়ার কথা জানালেন, গুঠিয়া গ্রামের তালেব আলী, জল্লার দিলিপ মÐল, হারতার অশোক দাস, জীবন হালদার, ভরসাকাঠির নাসির উদ্দিন, কামাল হোসেনসহ অনেকেই।
গৌরনদীর মাহিলাড়া বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী, দুলাল সরদার, গৌরনদী বন্দরের মতিউর রহমান, আগৈলঝাড়ার সবজি ব্যবসায়ী কামরান হোসেন, টরকী বন্দরের জালাল হোসেনসহ অনেকেই জানান, তারা আগে যশোর থেকে সবজি আমদানি করতেন বর্তমানে যশোরের চেয়ে ভাল মানের টাটকা সবজি উজিরপুরের গুঠিয়া, হারতা, জল্লা ও বামরাইলে পাওয়া যায়। ফলে খুব সকালে ক্ষেত থেকে তুলেই ওই টাটকা সবজি ক্রেতাদের হাতে দেয়া যায়। তেমনি পরিবহন খরচ কম থাকায় দাম কিছুটা সস্তা।
বামরাইল ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উজিরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোঃ তোফাজ্জেম হোসেন কৃষকদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা কৃষকদের সার্বিক পর্যবেক্ষন করে সহযোগীতা ও পরামর্শ দিয়ে আসছি। এ বছর গতবারের তুলনায় সবজি চাষী সংখ্যা প্রায় দেড়গুন বেশী। বর্তমানে বাজারে সার, বীজ ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। এসবের দাম নিয়ন্ত্রনে থাকলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হতেন। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো: রফিকুল ইসলাম জানান, উপজেলায় নয়টি ইউনিয়নে ব্যাপক হারে সবজি চাষ হয়েছে। সেই সাথে উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরাও কৃষকদের সাবির্ক সহযোগীতা ও পরামর্শ প্রদান করে আসছি। যার কারনে এ বছর সবজির ফলন খুব ভালো হয়েছে। পাশাপাশি দামও ভালো পাওয়ায় সবজি চাষে কৃষকদের আগ্রহ বহুগুনে বেড়ে গেছে। প্রতি বছরই নতুন নতুন শত শত সবজি চাষী সবজি চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন।
উজিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: জাকির হোসেন তালুকদার জানান, কম খরচে শীতকালীন সবজি চাষ কৃষকরা অনেক লাভবান হন। তাই এ বছর লক্ষমাত্রার চেয়েও অধিক জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা সরাসরি জমি থেকে কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক কৃষক নিজের জমির উৎপাদিত সবজি নিজেই বাজারে নিয়ে বিক্রি করছেন। সবজি চাষ করে এ অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষ স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কৃষকদের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিষয়ে কিছু কথা রয়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।