গৌরনদী
করোনা যুদ্ধে বিজয়ী চিকিৎসক দম্পত্তি নতুন জীবন ফিরে পেয়ে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে চান
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ নতুন জীবন পেয়েছি, নতুন স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই। করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসায় মানুষের প্রতি সেবা প্রদানের দায়িত্ববোধ যেন আরো অনেকটা বেড়ে গেল। যতদিন বেঁচে থাকবো মানুষকে সেবা দানের নতুন স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকবো। কথাগুলো বলছিলেন করেনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসা বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাঃ রাজু বিশ্বাস ও স্ত্রী একই উপজেলার বাকাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক অনামিকা বিশ্বাস। চিকিৎসক দম্পত্তি জানান, “করেনায় আক্রান্ত হলে ভয় নয়, সচেতন হতে হবে। সুস্থ্যতার জন্য নিজের মনোবল ও স্বজন, সহকর্মীর সহানুভূতি ও অনুপ্রেরনা খবুই প্রয়োজন”। দুজনই ৩৯তম বিসিএস ক্যাডার। তাদের বিয়ের বয়স মাত্র ৪ মাস।
আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ বখতিয়ার আল মামুন জানান, সর্দি জ্বর ও কাষিতে আক্রান্ত হন আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক অনামিকা বিশ্বাস (২৭)। নমুনা সংগ্রহ করে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার ল্যাবে পাঠানো হলে ১৩ এপ্রিল তার করেনা পজেটিভ সনাক্ত হয়। পরবর্তিতে ডাঃ অনামিকার সংস্পর্শে থেকে আক্রান্ত হন স্বামী ডাঃ রাজু বিশ্বাস। উভয়েই বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে ঢাকা কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে বর্তমানে গৌরনদীর ভাড়াটে বাসায় ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছে। ডাঃ রাজু বিশ্বাস ও অনামিকা বিশ্বাস দুজনেই জানান, বাবা মায়ের ইচ্ছায় চিকিৎসক হয়েছি। আমাদের স্বপ্ন চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত মানুষকে সেবা দেয়া। সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজু বিশ্বাস বলেন, গত ১৩ এপ্রিল স্ত্রী অনামিকা বিশ্বাসের করোনা সনাক্ত হওয়ার পরে সিদ্বান্ত নেই বিষয়টি গোপন রেখে বাসায়ই চিকিৎসা নিবো। সে অনুযায়ি স্ত্রীকে নিয়ে গৌরনদী সদরে ভাড়াটে বাসায় অবস্থান করি। কিন্তু ওই সন্ধ্যায় বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মধ্যে রাতটি কোন রকম কাটিয়ে ১৪ এপ্রিল সকালে আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে যাই সেখান থেকে স্যারে (স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।
তখনও আমার করোনা সনাক্ত হয়নি। ১৬ এপ্রিল আমার করোনা সনাক্ত হয়। অনামিকার সর্দি জ্বর কাষি, গলাব্যাথা পাতলা পায়খানাসহ সব ধরনের উপসর্গ ছিল কিন্তু আমার মধ্যে কোন উপসর্গ ছিল না। অনামিকার চেয়ে আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকায় আমার সামান্য শুকনো কাসি ছিল। দুজনার করোনা সনাক্ত হওয়ার পরে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে অনেকটা ভেঙ্গে পরলাম। ভাবলাম হে ঠাকুর জীবন এখানেই থেমে যাবে। ওই সময় দেশে প্রথম দুজন ডাক্তার মারা যাওয়ায় আমাদের মধ্যে আতঙ্কটা বেশী ছিল। বরিশালে ঝুঁকি না নিয়ে আমরা দুজনই ঢাকা কুর্মিটোলা চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্বান্ত নিয়ে ১৮ এপিল বরিশাল থেকে ঢাকা চলে যাই। কুর্মিটোলা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত চিকিৎসা নেওয়ার পরে একাধিক পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসায় আমাদের চিকিৎসার পরাপর্শপত্র দিয়ে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেন।
সুস্থ্য হওয়ার চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাঃ অনামিকা বলেন, সুস্থ্য হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন মনোবল এবং সাহস, কাছের মানুষের ভালবাসা ও প্রেরনা। এগুলো ঔষাদের চেয়ে বেশী কাজ করে। আমরা দুজনেই বরিশাল ও ঢাকা কুর্মিটোলায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সহকর্মী চিকিৎসক ও সিনিয়র স্যারদের কাছ থেকে যে সাহস, প্রেরনা ও পেয়েছি তাতে বুঝেছি চিকিৎসার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। ক্যাডার হিসেবে হাসপাতালে আমরা যে সার্ভিস পেয়েছি এটা সব রোগী পায় কি না জানিনা। তবে এটা একজন আক্রান্ত রোগীর সুস্থ্য হতে খুবই সহায়ক। সঙ্গে আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ দিয়ে হাল্কা গরম পানি করে দিনে ৩/৪ বার খেয়েছি। গরম পানিতে লবন মিশিয়ে ৩/৪ বার গরগরা করেছি। পানি ফুটিয়ে ভাব নিয়েছি (ম্যানথল ছাড়া)। সুস্থ্য হওয়ার জন্য এগুলো খুবই কার্যকর চিকিৎসা। এ ছাড়া স্যারদের পরামর্শ অনুযায়ি নিয়মিত ঔষাধ সেবন করেছি। ডাঃ রাজু বিশ্বাস বলেন, মনোবল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকলে করোনা কিছুই করতে পারে না। যারা ডায়াবেটিকস, হার্ড, শ্বাকষ্ট, এ্যাজমা লিভারে আক্রান্ত ও ধুমপায়ী তাদের জন্য করোনা বেশী ঝুকিপূর্ন। তরুন, কিশোর ও যুবকদের জন্য খারাপ পরিস্তিতির সম্ভবনা খুবই কম।
সুস্থ্য হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ হিসেবে তারা বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা নেওয়া সবচেয়ে ভাল। কারন হাসপাতালের পরিবেশ দেখে কখনো কথনো রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। করোনার সতর্কতা মেনে কোয়ারেন্টিনে থেকে চিকিৎসা গ্রহন সঙ্গে আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ দিয়ে হাল্কা গরম পানি করে দিনে ৩/৪ বার খেয়েছি। গরম পানিতে লবন মিশিয়ে ৩/৪ বার গরগরা করা, পানি ফুটিয়ে ভাব নেওয়া (ম্যানথল ছাড়া) রোগী দ্রæত সুস্থ্য হবে। যদি রোগীর শ্বাসকষ্ট ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হয় বা ডায়রিয়া গুরুতর অবস্থায় হয় তাহলে হাসপাতালে পাঠানো উচিত।
করোনায় আক্রন্ত কালে তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাঃ রাজু বলেন, এ সম্পর্কে কথা না বলাই ভাল। কারন মুহুর্তের মধ্যে চিরচেনা জানা পৃথিবীটা অচেনা পৃথিবীতে পরিনত হয়। কাছের মানুষগুলোর অচেনা রুপ দেখা যায়। হারিয়ে যায় মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা- মমত্ববোধ। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা-আমরা করোনা আক্রান্ত না হলে হয়তো এ অভিজ্ঞতার কথা অজানা থেকে যেত। যেই রাতে স্ত্রী অনামিকার করোনার আক্রান্ত হওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সেই রাতে বাসায় থাকার দূর্বিসহ পরিস্থিতি তৈরী হয়। করেনাকে ভয় নয়, সচেতনভাবে মোকাবেলা করতে মানুষের প্রতি মানবিকতার হাত বাড়ানো উচিত।