বরিশাল
আসছে বর্ষা-বাড়ছে ঝুঁকি * দখিনের অধিকাংশ লঞ্চের নেই ফিটনেস * দুর্ঘটনার শঙ্কা
-
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম ঃ আসছে কালবৈশাখীর মৌসুম। ঝুঁকি বাড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের নৌ-পথের যাত্রীদের। প্রতিবছর ঝড়ের মৌসুম আসলেই নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলে নৌ-দুর্ঘটনায় যাত্রীদের প্রাণহানি ঘটে। অথচ দীর্ঘ এ নৌ-পথ সুরক্ষায় আজও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে নিয়মনীতি ছাড়াই মেঘনার ডেঞ্জার জোনসহ বিভিন্ন রুটের নৌ-যানগুলো যাত্রী নিয়ে বেপরোয়াভাবে চলাচল করে। ঢাকা-বরিশাল রুটের দোতলা, তিন তলা লঞ্চ থেকে শুরু করে এমএল টাইপের ছোট লঞ্চ এমনকি ট্রলারগুলো (ইঞ্জিন চালিত নৌ-যান) নিয়মনীতি না মেনে ইচ্ছে মাফিক যাত্রী পরিবহন করে আসছে। সূত্রমতে, এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে নৌ-যান। বেসরকারি লঞ্চগুলোই সিংহভাগ যাত্রী পরিবহন করে। প্রায়বছরই বর্ষা মৌসুমে ও ঈদ-কোরবানীতে দক্ষিণাঞ্চলে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ঘটনার পরপরই বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় নানান তৎপরতা শুরু করে। পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে সবকিছু থেমে যায়। লঞ্চ মালিকরা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী নৌযান পরিচালনা করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৫ মার্চের পর মেঘনার ডেঞ্জার জোনে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নিয়ম রয়েছে। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী উত্তাল হয়ে উঠবে কিন্তু দৌলতখান-আলেকজেন্ডার, মনপুরা-হাতিয়া, বেতুয়া-তজুমদ্দিন-হাকিমউদ্দিন ও গলাচিপা-রাঙ্গাবালি, চরবিশ্বাস, বড়বাইশদিয়া, ছোট বাইশদিয়াসহ ঝুঁকিপূর্ন রুট গুলোতে ট্রলার বা একতলা লঞ্চের পরিবর্তে বর্ষাকালীন নৌ-যান যুক্ত করার কোন উদ্যোগ নেই। বর্ষা মৌসুমে এসব রুটে বিআইডব্লিউটিসি’র সি-ট্রাক এর বাইরে ছোট্ট নৌ-যান চলাচলের নিয়ম নেই। তবু চলে অবৈধ নৌ-যান। ফলে দূঘর্টনায় মারা যায় সাধারন মানুষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার মৌসুমের শুরুতেই অবৈধ নৌ-যান বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তবে বিআইডব্লিউটিসি এসব রুটে প্রয়োজনীয় সি-ট্রাক দিতে না পারলে যাত্রী দূর্ভোগ বেড়ে যায়। তখন অবৈধ নৌ-যান চলাচল ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়ে। কর্মকর্তারা আরও জানান, ফিটনেস বিহীন নৌ-যানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার জন্য সব সময়ে চাহিদা অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্টেট ও পুলিশ পাওয়া যায় না। তবুও আগামী ১৫ মার্চের পর মেঘনার ডেঞ্জার জোনসহ ঝুঁকিপূর্ন রুটগুলোতে অবৈধ নৌ-যান চলাচল বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে পত্র দেওয়া হবে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, শুধু মেঘনার ডেঞ্জার জোন আর অভ্যন্তরীন ঝুঁকিপূর্ন রুট নয়, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ঢাকা-বরিশাল রুটে রোটেশন পদ্ধতিতে চলাচল করছে দোতলা-তিনতলা লঞ্চ। ঢাকা ও বরিশাল উভয় প্রান্ত থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র রুট পারমিট অনুযায়ী প্রতিদিন সাতটি লঞ্চ ছাড়ার কথা থাকলেও প্রায় দেড় যুগ ধরে যাত্রীদের জিম্মি করে উভয়প্রান্ত থেকে ৪/৫টি করে লঞ্চ পরিচালনা করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৪৩টি রুটে একইভাবে রোটেশন পদ্ধতিতে লঞ্চ পরিচালনা করে যাত্রীদের জিম্মি করে রাখা হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে যেসব ছোট লঞ্চ চলাচল করে তা খুবই নাজুক। বর্ষাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রীদের উঠতে বাধ্য করা হয়। দক্ষ মাষ্টার, সুকানী ও ড্রাইভার ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে এ অঞ্চলের নৌপথে দীর্ঘদিন লঞ্চ চলাচল করছে। ফলে বর্ষা মৌসুম আসলেই বাড়ে দুর্ঘটনার আশংকা। তবুও দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে ঝুঁকিপূর্নভাবে বাধ্য হয়ে নৌযানে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র হিসাব মতে, দক্ষিণাঞ্চলে নৌ-রুট রয়েছে ৮৮টি। এরমধ্যে ঢাকার সাথে সরাসরি নৌযান চলাচল করে ৪৩টি রুটে। সরকারি হিসাব মতে, প্রতিদিন নৌ-পথে এ অঞ্চল থেকে যাতায়াত করে দেড় লক্ষাধিক যাত্রী। লঞ্চ মালিকরা ট্যাক্স ফাঁকির জন্য যাত্রী পরিবহন কম দেখানোরও অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী সুন্দরবন-৭ লঞ্চে যাত্রী ধারন ক্ষমতা সরকারি হিসেবে ৯৯০জন কিন্তু কখনই সহস্রাধিক যাত্রীর নিচে ওই লঞ্চটি গন্তব্যে রওয়ানা হয়না, এ লঞ্চে বয়া আছে মাত্র ১৫৩টি। সুরভী-৭ লঞ্চে বয়া আছে ১০৭টি, যাত্রী ধারন ক্ষমতা ১২৫০জন। সুরভী-৬ লঞ্চে যাত্রী ধারন ক্ষমতা ৮৯০জন, বয়া আছে ১২৫টি। কীর্তনখোলা-১ লঞ্চের ধারন ক্ষমতা ৭১৫জন, বয়া আছে মাত্র ১’শ টি। নিয়ম অনুযায়ী চারজন যাত্রীর জন্য একটি করে বয়া থাকার কথা। কাগজে কলমের হিসেবে ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবের সাথে তার কোন মিল নেই। বিলাসবহুল লঞ্চগুলোর যখন এ অবস্থা তখন ফারহান, টিপু, দ্বীপরাজ ও কালাম খানসহ অপর লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের উঠতে হয় সৃষ্টি কর্তার ওপর ভরসা করে।
বড় লঞ্চগুলোর মতো এম.এল টাইপের একতলা লঞ্চগুলো নিয়ম ভেঙ্গে চলাচল করছে বড় বড় নদীতে। যাত্রী পরিবহনকারী ছোট লঞ্চের মধ্যে অর্ধেক লঞ্চেই প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মাষ্টার, ড্রাইভার নেই। লঞ্চগুলো চালায় খালাসী ও হেলপাররা। ফিটনেস সনদ গ্রহনের সময় অভিজ্ঞ চালক ও মাষ্টারদের সনদ দেখিয়ে রুট পারমিট নেওয়া হয়। অদক্ষ মাষ্টার ড্রাইভার দ্বারা লঞ্চ চালাতে গিয়ে অধিকাংশ দূর্ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। নৌ-বন্দর থেকে প্রতিবছর সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আয় হলেও নৌ-পথ সুরক্ষায় নেই কোন বাস্তব উদ্যোগ।