গৌরনদী
ভিসা পেয়ে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পুরনের আগেই চিরবিদায় নিল জামাল, নিভে গেল মেয়ে জিতুর লেখাপড়ার স্বপ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বিদেশ গিয়ে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে, মেয়ে লেখা পড়া করে অনেক বড় হবে। সেই আশায় অনেক কষ্ট করে সৌদি আবর যাওয়ার ভিসাসহ সব প্রস্তুুতি সম্পন্ন করার পরে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পুরনের ৫ দিন আগেই চিরবিদায় নিয়ে চলে জামাল সিকদার। এতে ওর (জামালের) সুখের স্বপ্নর কবর রচনাই হয়নি সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল মেয়ে নুজহাত হোসেন জিতুর লেখা পড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন। একটি বুলেট তছনছ করে দিল আমার সুখের সংসার, কোথায় যাবো-কোথায় থাকবো-কিভাবে বাঁচবো, সামনে শুধুই অন্ধকার। কথাগুলো বলছিলেন ২০ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টায় ঢাকা চিটাগাং রোডের পাইনদী ডাচ বাংলা ব্যাংকের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের মৃত মহসিন সিকদারের পুত্র জামাল সিকদারের বিধুবা স্ত্রী শিউলী আফরোজ (৩৩)। জামাল সিকদার ঢাকায় রং মিস্ত্রীর কাজ করতেন এবং স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে রায়ের বাজারে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।
সোমবার সকালে নিহত জামাল সিকদারের গ্রামের বাড়ি পূর্ব হোসনাবাদ গিয়ে দেখা যায় আড়িয়াল খার নদীর শাখা পালরদী নদীর তীরেই ছিল জামালের বাড়ি । কয়েক বছর আগে নদী ভাঙ্গনে বাড়িটি নদীতে সম্পূর্নভাবে বিলীন হয়ে গেছে। পৈত্রিক ভিটামাটি কিছুই নাই, ভাঙ্গন কবলিত তীরে প্রায় এক শতাংশ জমিতে বাবা-মায়ের কবরের পাশেই নিহত জামাল সিকদারকে কবর দেয়া হয়েছে। এ কবরগুলোও যে কোন সময় নদী গ্রাস করে নিবে। কবরের পাশে বসেই কান্না করছে নিহত জামাল সিকদারের স্ত্রী শিউলী আফরোজ (৩৩) ও একমাত্র কন্যা এবারে এইচএসসি পাশ করা মেধাবী ছাত্রী নুজহাত হোসেন জিতু। মা মেয়েকে শান্তনা দিচ্ছে গ্রামের অসংখ্য নারী-পুরুষ কিন্তু কোন শান্তনাই যেন মা-মেয়ের কান্না থামাতে পারছে না। দাফনে স্বামীর লাশ নিয়ে গ্রামে এসে বাড়ি ঘর না থাকায় মেয়েকে নিয়ে পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের মোবারক মালের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন শিউলী আফরোজ।
এ সময় নিহতের স্ত্রী শিউলী আফরোজ জানান, নদী বাড়ি ঘর গ্রাস করার পরে ২০০২ সালে তাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। বড় ভাই আবুল কালাম রং মিস্ত্রীর কাজ করত। তার সাথে থেকে ও (জামাল) রং মিস্ত্রীর কাজ শিখে অনেক কষ্ট করে কাজ করে সংসার চালাত। পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে অনেক দিনের আশা ছিল বিদেশ যাবে, মেয়েকে লেখা পড়া করিয়ে অনেক বড় করবে। ধার দেনা করে সাড়ে ৫লাখ টাকায় সৌদি আরবে যাওয়ার ফ্রি ভিসাসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। একমাত্র মেয়ে নুজহাত হোসেন জিতুকে (জিপিএ-৪.৫) গত ১৭ জুলাই ধানমন্ডি বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজে ভর্তি করেছে। জামালের ২৫ জুলাই বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। তাই ঘুরে ঘুরে ঢাকায় থাকা সকল আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। ঘটনার দিন সকালে খালার কাছে বিদায় আনতে চিটাগাং রোড পাইনদী নতুণ মহল্লার বাসায় যান। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকেল ৫টায় শ্যালক তাওহীদ চৌধুরীকে নিয়ে কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যাওয়ার পথে চিটাগাং রোডের পাইনদী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বিদেশ যাওয়ার তিন দিন আগেই আখেরী ভিসা নিয়ে চির বিদায় নিয়ে চলে গেল বলেই কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যান শিইলী। এ সময় নিহত জামালের কলেজ পড়–য়া একমাত্র মেয়ে নুজহাত হোসেন জিতু অঝোরে কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার বাবা ছিল আমার একমাত্র আশ্রয় স্থল, আল্লাহ আমার আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়েছে। আমি এবারে বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজে ভর্তি হয়েছি। জানি না কি করে মাকে নিয়ে আগামি দিনগুলো চলবো, পড়াশোনায় অনেক খরচ, জানি না কিভাবে আমি পড়াশোনা করবো? বাবা বলত আমি বিদেশ গিয়ে টাকা পাঠাবো তুমি ভালভাবে পড়াশোনা করবা, ভাল কলেজে পড়াশোনা করবা, আমি অভাবে লেখাপড়া করতে পারি নাই, মা তুমি আমার স্বপ্ন পুরন করবা। কিভাবে বাবা তার স্বপ্নগুলোকে এবং আমার স্বপ্নগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে চলে গেছে। আমি এখন নিঃশ্ব কি হবে আমার?
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিহত জামালের শ্যালক মোঃ তাওহীদ চৌধুরী ((২৭) দুলা ভাই জামাল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার লোমহর্ষক ঘটনার বর্ননা দিয়ে বলেন, আমি দুলা ভাই জামালকে নিয়ে বিদেশে যাওয়ার মার্কেট করার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে রিকসা নিয়ে চিটাগাং রোড ডাচবাংলার কাছাকাছি পৌছে দেখি সামনে গন্ডগোল হচ্ছে। একটি ৬তলা বিল্ডিং থেকে এবং হেলিকপ্টার থেকে পুলিশ মুহু মুহু গুলি করছে। তখন দুলাভাইকে বলি আজকে মাকের্টে যাওয়ার দরকার নাই, চল আমরা বাসায় ফিরে যাই বলে পিছনে ফিরে বাসার দিকে দুজনে দৌড়াতে থাকি। দুলাভাই আমার পিছনে ছিল কিছুদুর যেতেই পিছনে ফিরে দেখি দুলাভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধরতে গেলে আমাকে লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। কিভাবে আমি প্রানে বেঁচেছি তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। তার মধ্যে দুলা ভাইকে টেনে হেচরে কিছু দুরে নিয়ে সিএনজিতে করে খানপুর হাসপাতালে নিয়ে যাই হাসপাতাল গেলে তারা জানান এই রোগীর চিকিৎসা এখানে হবে না আপনারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান । তাদের কথামত ঢাকা মেডিকেল কলেজে রওয়ানা হলে পথিমধ্যে দুলাভাই মারা যান। দুলা ভাই সৌদি আরবে না গিয়ে গুলি খেয়ে চির দিনের জন্য বিদেশ চলে গেল। পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হেমায়েত উদ্দিন (৭০) বলেন, জামালের পৈত্রিক ভিটামাটি নদী ভাঙ্গলে চলে যাওয়ার পরে ছোট বেলা থেকে ঢাকায় গিয়ে রং মিস্ত্রীর কাজ করে অনেক কষ্ট করে জীবন যাপন করতেন। পরিবারটি খুবই হতদরিদ্র হলেও জামাল অনেক ভাল মানুষ ছিল। ওর বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে গ্রামের মোস্তাফিজুর, স্থানীয় জামাল মেম্বরসহ ৪/৫ জনে প্রায় আড়াই লাখ টাকা দিয়েছে। জামাল চলে যাওয়ায় পরিবারটির সব শেষ হইয়া গেল। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জনাই জামালের মেয়ের পড়াশোনাসহ যাতে বিধূবা স্ত্রীকে নিয়ে বাঁচতে সেই ব্যবস্থা করে দিতে। গ্রামের সাফিয়া বেগম (৭২), আলী আকবর (৬০) বকুল বেগম (৫০) শাহজাহান খলিফা (৫৫) বলেন, ভিটে মাটি না থাকায় নিহত জামাল সিকদার গ্রামের বাড়ি আসলে গ্রামের সবাই তাকে আশ্রয় দিত খাবার দিত। পরিবারটির পাশে দাড়াতে সরকারের প্রতি তারা আহবান জানান।