গৌরনদী
গৌরনদীতে চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব, লাখ লাখ টাকার লুট
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম ঃ গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের বিল্লগ্রাম হাট ব্রিজ থেকে জঙ্গলপট্রি মাদ্রসা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটর সড়কে চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব। প্রভাবশালীরা কেটে নিয়েছে প্রায় সহ¯্রাধিক ছোট বড় গাছ। লুট হওয়া গাছের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। গত ৭দিন ধরে এসব কেটে নেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন কিছুই জানেন না।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন, সুবিধাভোগী ও এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল এলজিইডি ক্ষুদ্রাকর পানি সম্পদ উন্নয়ন সেক্টর প্রকল্পের অধীনে গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়ন পানি ব্যবস্থানা সমবায় সমিতি ২০০১-২০০২ অর্থ বছরে বিল্লগ্রাম হাট ব্রিজের গোড়া হইতে জঙ্গলপক্রি মাদ্রাসা পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটর সড়কে সামাজিক বনায়ন করেন। এ সড়কের দুই পাশে রেন্ট্রি, মেহগনি, কড়াই, শিশু, রাজ কড়াইসহ বিভিন্œ প্রজাতির প্রায় ১০ হাজার গাছের চারা লাগানো হয়। চারা লাগানোর পরে ১৮ মাস পর্যন্ত রোপনকৃত চারা সংরক্ষনে ১০ জন কেয়ার কেটার সার্বক্ষনিকভাবে পাহারা নিয়োগ ছিল।
মাহিলাড়া ইউনিয়ন পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন জানান, সমবায় সমিতির অধীনে ৪০৫ জন সদস্য রয়েছে। সামাজিক বনায়নের এই সম্পদ তাদের। ২০০১ সালে লাগানোকৃত গাছ বর্তমানে সম্পদে পরিনত হয়েছে। যার বর্তমান মূল্য অর্ধকোটি টাকারও বেশী। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী সামাজি বনায়নের গাছের শতকরা ১০ ভাগ ইউনিয়ন পরিষদ, শতকরা ২০ ভাগ সড়কের পাশের জমির মালিক, শতকরা ৭০ ভাগ সমবায় সমিতির সদস্য বা সুবিধাভোগীরা ভোগ করার কথা রয়েছে। উপজেলার বিল্লগ্রাম গ্রামের প্রভাবশালী গোপী রায় জীবন পাল, প্রেমা পাল, সুকণ্ট পাল, সুশীল পাল, বড় জীবন পাল, রশিদ খান, সুজন নন্দী, ৩০/৩৫ জন ব্যক্তি সড়কের ছোট বড় গাছ প্রায় সহ¯্রাধিক বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। স্থানীয় গাছের ব্যবসায়ী মো. হাসান, মো. সুলতানমো. জহিরুল ইসলাম, মো. তৈয়ব আলী, মো. দুলালসহ ১০/১২ জন ব্যবসায়ী ওই গাছ কিনে কেটে নেন।
স্থানীয় মো.মেহেদী হাসান, কহিনুর বেগমসহ কয়েকজন জানান, গত ৭দিন ধরে গাছ ব্যবসায়ীরা নির্বিচারে গাছ কেটে গৌরনদীর বিল্লগ্রামÑ ধামুরা খালে ট্রালার লাগিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাছ পাচার করেন। এ যেন গাছ কাটার মহোৎসব, লুটে নেয় ৩৫ লাখ টাকার গাছ। এমন কি ১০ বছরের ছোট গাছও কেটে নেন। তারা বলেন গাছ কাটার বিষয়টি কর্তপক্ষকে অবহিত করার পরে তারা কোন ব্যবস্থা নেননি।
উপজেলা বন ও পরিবেশ সংরক্ষন কমিটির এক সদস্য বলেন, কোন সামাজিক বনায়নের গাছ কাটতে হলে উপজেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভার অনুমোদন লাগবে। অনুমোদনের পরে বরিশাল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সামাজিক বন বিভাগের (ক) ফরমে আবেদন করার পরে গাছ কাটার অনুমতি সাপেক্ষে গাছ কাটতে পারবে কিন্তু প্রভাবশালীরা আইনের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে হরিলুট চালাচ্ছে। যা দেখার কেউ নেই। মাহিলাড়া ইউনিয়ন পানি ব্যবস্থানা সমবায় সমিতির সদস্য জাহানারা বেগম, জালঅল আহম্মেদ, তালেব আলী বেপারী, মমতাজ বেগম বলেন, মোরা হারা বছর গাছ পাহারা দিয়া রাখলাম এ্যাহন গাছ বড় হওয়ায় ক্ষেমতা আলা লোকেগো নজর পড়ছে। হেরা মোগো সম্পদ লুট কইররা নেয়। মোরা গাছ লুটেরারাগো বিচার চাই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিল্লগ্রাম হাট ব্রিজের গোড়া হইতে দক্ষিন দিকে জঙ্গলপট্রি মাদ্রাসা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটর সড়কের দুই পাশে সারি সারি গোড়া পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় গাছ গুলো সদ্য কেটে নেওয়া হয়েছে। এক কিলোমিটার সড়কে কেটে নেওয়া গাছের গোড়া গুনে দেখা গেছে ছোট বড় সাড়ে তিন শত গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। এখনো সড়কের উপর পড়ে আছে অসংখ্য গাছের গুড়া। গাছগুলো কাটার ফলে সড়কটির বেহাল অবস্থা তৈরী হয়েছে। সড়কটির বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে খালের মধ্যে বিলিন হয়ে গেছে। এসময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংরক্ষিত আসনের এক ইউপি সদস্য বলেন, প্রভাবশালীরা গাছ বিক্রির পরে ব্যবসায়ীরা শতাধিক শ্রমিক নিয়ে নির্ভয়ে গাছ কেটে ট্রলারযোগে নিয়ে যায়।
মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, গাছ কাটার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পরেও তারা কোন ব্যবস্থা নেননি। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায় ৪০ লাখ টাকার গাছ লুট করে নিয়ে গেছে। গাছ কাটতে বাধা দেয়ায় আমি বিরোধে জড়িয়ে পড়ি তারপরেও লোকজন নিয়ে গাছ ব্যবসায়ীদের লেবারদের গাছ কাটা সরঞ্জাম ও অসংখ্য গাছ আটক করেছি।
গাছ বিক্রতা প্রভাবশালী বিল্লগ্রাম গ্রামের রশিদ খান, নারায়ন পালসহ অনেকেই নিজেদের গাছ দাবি করে বলেন, সরকারি গাছ বিক্রি করি নাই আমরা নিজেদের জমিতে থাকা গাছ বিক্রি করেছি। সুকণ্ঠ পাল বলেন, আমি কিছুই জানি না যখন দেখিছি সবাই গাছ কেটে নিচ্ছে তখন আমিও আমার জমির মাথায় থাকা গাছ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। সুজন নন্দী বলেন, সবার দেখাদেখি আমিও ৪০ হাজার টাকার গাছ বিক্রি করেছে। গোপী রায় বলেন, আমি অসুস্থ্য গাছ বিক্রির কিছুই জানি না তবে আমার এক আত্মীয় সোয়া লাখ টাকার গাছ বিক্রি আমার জন্য কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমি ওই টাকা রাখি নাই। গাছ ক্রয়ের কথা স্বীকার করে গাছ ব্যবসায়ী ও মাহিলাড়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো. সুলতান আহম্মেদ বলেন, আমি একা নই অনেক ব্যবসায়ীই সড়কের গাছ কিনেছে, দাম কম হওয়ায় অধিক মুনাফার জন্য আমিও কিছু গাছ কিনেছি। গাছ ব্যবসায়ী মো. হাসান বলেন, সড়কের পাশের জমির মালিকরা নিজেদেরগাছ দাবি করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে গাছ বিক্রি করেছে। আমি প্রা য়দুই লাখ টাকায় ৭ জন মালিকের গাছ কিনেছি। একই কথা জানালেন গাছ ব্যবসায়ীরা।
গৌরনদী উপজেলা বন বিভাগের কর্মকর্তা মনিন্দ্র নাথ হালদার বলেন, সড়কের গাছ কেটে নেওয়ার বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। কেউই কোন অভিযোগ দেয়নি। গৌরনদী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সেলিম মিয়া বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী ফজল আহম্মেদ বলেন, গাছ কাটলে পরিবেশ ও বন সংরক্ষন কমিটিসহ স্থানীয় প্রশাসন দেখবে আমাদের কিছুই করার নাই। উপজেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউ,এন,ও) মো. মাহবুব আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, কমিটির অনুমোদন ছাড়া গাছ কাটা অবৈধ ও অন্যায় বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। । গৌরনদী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলাউদ্দিন মিলন ইউপি চেয়ারম্যান কর্তৃক জানানোর কথা অস্বীকার করে বলেন, আমাকে ইউ,এন,ও ও বন কর্মকর্তা পদক্ষেপ গ্রহনের অনুমতি না দেওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তারা অফিসিয়ালি আদেশ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।