গৌরনদী
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় উজিরপুর ও আগৈলঝাড়ার ৩ জন নিহত ॥ স্বজনদের কাঁন্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, সন্তানের মুখ দেখা হল না উজিরপুরের রফিকুলের
জহুরুল ইসলাম জহির, গত বৃহস্পতিবার সৌদি আরবে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন বরিশালের আগৈলঝাড়ার উপজেলার রতœপুর ইউনিয়নের ছয়গ্রাম গ্রামের আ. হাকিম হাওলাদারের পুত্র বাবুল হাওলাদার ও সহিদুল হাওলাদার দুই সহদর ও উজিরপুর উপজেলা জল্লা ইউনিয়নের বাহেরঘাট গ্রামের শহিদ হাওলাদারের পুত্র রফিকুল ইসলাম(৩২)। গুরুতর আহন হন রফিকুলের বর ভাই সাইফুল ইসলাম(৩৪)। দুই পরিবারেরই উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলোতে চলছে এখন শোকের মাতন। গতকাল শুক্রবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাবুল ও সহিদুলের বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান ও প্রতিবন্ধী ভাইর কান্নায় আকাশ বাতাশ ভাড়ি হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর খবর শুনে বাড়িতে ভিড় করেছে সহ¯্রাধিক লোক। সবাই যেন সান্তনার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। একই চিত্র দেখা গেছে উজিরপুর উপজেলার জল্লা গ্রামে নিহত রফিকুল ইসলাম বাড়িতে।
সরেজমিনে নিহত পরিবার, স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্টরা জানান, অগৈলঝাড়া উপজেলার রতœপুর ইউনিয়নের ছয়গ্রাম গ্রামের দিনমজুর আ. হাকিম হাওলাদারের চার পুত্র দুই কন্যা নিয়ে অভাবি সংসার। একা দিনমজুরের কাজ করে অভাব অনাটনে সংসার চলে। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া করার কোন সুযোগ ছিল না। তাই সুখ নামে সোনার হরিন ধরার জন্য ভিটে মাটি বিক্রি করে বড় পুত্র বাবুল মেজ পুত্র সহিদুল ২০০৭ সালে সৌদী আরবে যান। সেখানে তারা দুই স্যানিটারী ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনেন।
সৌদি আরবে নিহতদের স্বজন মো. শাহ জালালসহ একাধিক জন মোবাইল ফোনে জানান, বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের সময় ভোর ৫টার দিকে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ছয়গ্রামের বাসিন্দা হাকিম হাওলাদারের পুত্র বাবুল হাওলাদার(৪৫) ও সহদর শহিদুল হাওলাদার (৩৪), উজিরপুরের জল্ল¬া ইউনিয়নের জল্লা গ্রামের শহিদ হাওলাদারের পুত্র রফিকুল ইসলাম(৩২) আহত হন বড় ভাই সাইফুল ইসলাম(৩৪), ভোলার সাহাবুদ্দিন(৩৬), পটুয়াখালী বাচ্চু (৩৮)ও পাবনার রানা (৪০)মাইক্রোবাসযোগে কর্মস্থলের যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ সময় সকাল আটটার দিকে দামাম শহরের আল জুবাইল-ডাহারান সড়কে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়জন নিহত ও সাইফুল ইসলাম গুরুতর আহত হয়। আহতকে সৌদির কাতিপ হাসপাতালে ভর্তি ও নিহতদের একই হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার নিহতের বাড়ি আগৈলঝাড়ার রতœপুর ইউনিয়নের ছয়গ্রাম গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে চলছে শোকের মাতন। স্বজনদের হৃদয় বিদারক কাঁন্নায় আক্শা বাতাশ ভারি হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর খবর শুনে সহ¯্রাধিক গ্রামবাসী ও স্বজনরা বাড়িতে ভির করলেও সবাই যেন শান্তনা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সকলেই নির্বাক তাকিয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন নিহত বাবুল ও সহিদুলের বৃদ্ধ বাবা মাসহ নিহতর স্ত্রীরা। নিহতর পিতা আঃ হাকিম হাওলাদার (৭০) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মোগো হগোলডির সুখের লাইগ্যা বাজানরা কত কষ্ট করত, অভাবি সংসারে সুখের মুখ দেখাইছে হেই সময় বাবাগো আল্লা লইয়া কেন? এ্যাহন মোরা কি কইরা চলমু। আল্লা মোরে ক্যান নিলা না।
বৃদ্ধা মা নুরজাহান বেগম (৬৫) বিলাপ করে বলেন, কে মোর কলিজার টুকরা বাবুল ও সহিদুলরে মোর বুকে কে আইন্না দিবে? ও আল্লা একি তুমি করলা। মোর বাজানরা কষ্ট কইররা আয় কইরা নিজেরা সুখ করে নাই, মোগো সুখের লাইগ্যা দিন রাত কাম (কাজ) করত। কে চালাবে মোগো সংসার? কি দিয়া চলবে আমার সোনা মনিদের (নাতি ) লেখা পড়া। নিহত সহিদুলের স্ত্রী সালমা বেগম (২৮) জানান, তার সঙ্গে শেষ কথা হয় গত বুধবার (মৃত্যুর আগের দিন) ফোনে সহিদুল তাকে বলেন আমার আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ায় বাড়িতে টাকা পাঠাতে দেরি হবে। কষ্ট করে চল। ৮ বছরের মেয়ে অথৈ ও ৪ বছরে আতিয়ার পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখতে বলেন। নিহত বাবুলের স্ত্রী শিরিন বেগম জানান, আমার নাবালক ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথায় গিয়ে দাড়াবো?
নিহত বাবুলের পুত্র ৯ম শ্রেণীর ছাত্র শাকিব হাওলাদার আর্তনাদ করে বলেন, মোরে বাবায় কইছিল বাড়ি আসার সময় তোর লাইগ্যা মোবাইল নিয়া আসবো তুই মন দিয়ে লেহা পড়া কর। নিহত বাবুল ও সহিদুলের ছোট ভাই প্রতিবন্ধী নান্নু হাওলাদার কান্নাজড়িত কন্ঠে বিলাপ করে বলেন, ভাইয়েরা মোর চিকিৎসা করাইতে টাহা দিত এ্যাহন মুই কি দিয়া চিকিৎসা করমু। নিহত বাবুলের ৪ বছরের মেয়ে হিমি জানেনা তার বাবা চলে গেছে না ফেরার দেশে। হিমি পিতার ছবি নিয়ে অপেক্ষায় বাবা কবে আসবে।
সন্তানের মুখ দেখা হল না রফিকুলের
সন্তানের মুখ দেখা হল না রফিকুল ইসলামের। ছুটি শেষে কর্মস্থল সৌদি আরবে ফিরে যাবার সময় বাড়ির স্বজনদের বলেছিলেন ক’মাস পর আবার বাড়িতে ফিরে এসে প্রথম আগত সন্তানের মুখ দেখবেন। তা আর হল না। গত বৃহস্পতিবার সৌদি আরবে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন বরিশালের উজিরপুর উপজেলা জল্লা ইউনিয়নের বাহের ঘাট গ্রামের শহিদ হাওলাদারের পুত্র রফিকুল ইসলাম(৩২)। গুরুতরভাবে আহত হন তার বড় ভাই সাইফুল ইসলাম(৩৪)। তাদের বাড়িতে চলছে এখন শোকের মাতন। বাবা-মা, স্ত্রী ও স্ব্জনদের কান্নায় আকাশ বাতাশ ভাড়ি হয়ে উঠেছে।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয়রা জানান, বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের বাহেরঘাট গ্রামের রফিকুল ইসলাম (২৮) চলতি বছরের ১৬আগষ্ট বড়ি থেকে তার কর্মস্থল সৌদি আরবে ফিরে যান । যাবার স্বজনদের বলেন, ক’মাস পর আবার বাড়িতে ফিরে এসে প্রথম আগত সন্তানের মুখ দেখবেন। তখন সবাইকে নিয়ে আনন্দ করবেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেই রফিকুল বাড়িতে ঠিকই আসবেন কিন্তু লাশ হয়ে। ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যাবার মাত্র এক মাস ৫দিনের মাথায় সৌদি আরবে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু ঘটেছে। ওই দূর্ঘটনায় তার আপন বড় ভাই সাইফুল ইসলাম গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার সরজমিনে জল্লার বাহেরঘাট গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে নিহত রফিকুল ইসলামের বাড়িতে হাজারো মানুষ ভীড় করেছে ওই পরিবারকে সান্তনা দেবার জন্য। দূর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়েছে ওই এলাকার পরিবেশ। নিহত রফিকুলের আপন ছোট ভাই রুবেল হাওলাদার আহাজারী করে বলেন, আমার ভাই এবার যাওয়ার সময় মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। আমরা বুঝতে পারিনি এটাই তার শেষ বিদায়। রফিকুলের পিতা সহিদ হাওলাদার কান্না জড়িত কন্ঠে তার নিহত ছেলের লাশটি তারাতাড়ি বাড়িতে পাঠানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী জানান। গুরুতর আহত অপর ছেলে সাইফুল ইসলামের সু-চিকিৎসারও দাবী জানান। স্থানীয় মজনু নামক এক যুবক জানিয়েছেন, জল্লা এলাকার সভ্য ও ভদ্র ছেলে হিসাবে বেশ পরিচিতি রয়েছে সাইফুল ও রফিকুলের। জীবিকার তাগিদে তারা দেশের বাহিরে গেলেও সাধার মানুষের সাথে ছিল তাদের নাড়ির টান। মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় রফিকুলের অকাল মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতে পারছেনা।
নিহত রফিকুলের স্ত্রী ইতি বেগম যেন বাকরুদ্ধ হয়ে ঘরের মধ্যে পরে আছেন। মাঝে মধ্যে লোক দেখলেই হাউ মাউ করে বলে ওঠে বলেন, ও আমার আগত সন্তানকে একনজর দেখে যেতে পারলোনা। এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো। তার এ আহাজারীতে সান্তানা দিতে আসা অনেকেই কাঁদতে দেখা যায়।
স্ত্রী ইতি বেগম আরো জানান, নিহত হওয়ার আগের দিন রাত ১০টায় তার ও পিতা মাতার সাথে মোবাইল ফোনে জীবনের সর্বশেষ কথা বলেন এবং আগত সন্তানের খোঁজ খবর নিয়েছিল। জল্লা রফিকুল । দীর্ঘ ৯বছর ধরে সৌদি আরবে চাকুরী করে আসছে। এরপর তার পরিবারের অন্য দুই সদস্য বড় ভাই সাইফুল ইসলাম ।