গৌরনদী
উজিরপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন কৃষি জমিতে অবৈধ ইটভাটা স্থাপন, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থী
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বরাকোঠা ইউনিয়নের লস্করপুর গ্রামে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দুটি হাটবাজার সংলগ্ন কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে পরিবেশ দূষনসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার এলাকাবাসি। এছাড়াও ইটভাটায় পোড়া হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে চার বছর আগে প্রশাসন ইটভাটাটি বন্ধ করে দিলে চলতি বছর নতুন নামে পুনরায় ভাটাটি চালু করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রশাসনের হস্থক্ষেপ কামনা করেছেন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাবাসি।
স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উজিরপুর উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়নের উত্তর লস্করপুর গ্রামে ২০১৫ সালে স্থানীয় সফিকুর রহমান ঘনবসতিপূর্ন এলাকায় তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দুটি বাজার সংলগ্ন কৃষি জমিতে মেসার্স সফিক এন্টারপ্রাইজ নামে সম্পূর্ন অনুমোদনবিহীন একটি ইটভাটা চালু করেন। এই ইটভাটা স্থাপনের ফলে এলাকার পরিবেশ দুষন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠিানের শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকায় স্থানীয় অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করে ইটভাটা বন্ধের আবেদন করেন ভূক্তভোগীরা। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে প্রশাসন মেসার্স সফিক এন্টারপ্রাইজ নামে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেন এবং দায় এড়াতে মালিক সফিকুর রহমান আত্মগোপন করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রশাসন কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া সেই একই স্থানে চলতি বছর নতুন করে একটি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে।
বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উজিরপুর উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়নের উত্তর লস্করপুর গ্রামে যেখানে ইটভাটা স্থাপন করা তা ঘরবসতিপূর্ন এলাকা। ভাটার তিনপাশে কৃষি জমি ও একপাশে একটি ঘের রয়েছে। ইটভাটার সন্নিকটে রয়েছে ৪৭নং মালিকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়াকোঠা ইউনিয়ন মাধ্যমিক ইনষ্টিটিউশন ও বড়াকোঠা ইউনিয়ন ডিগ্রি কলেজ। দুই পাশে রয়েছে ডাবেরকুল বাজার ও চৌধুরীর হাট। ভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। আশপাশে স্তুপ করে রাখা আছে কাঠের লাকরী। ভাটার ধোয়ায় এলাকার পরিবেশ দূষনসহ ধুলা বালিতে যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে পথচারীদের। এ সময় স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে বন্ধ করে দেয়া ইটভাটা নতুন নামে চলতি বছর চালু করা হয়েছে। এতে তাদের বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রশাসন মেসার্স সফিক এন্টারপ্রাইজ নামে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেন এবং দায় এড়াতে মালিক সফিকুর রহমান আত্মগোপনে চলে যান। এ বছর পুরানো সেই ইটভাটার মালিক সফিকুর রহমান স্থানীয় মোঃ রিপন হাওলাদার ও রুবেল খলিফার কাছে ইটভাটার জমি ইজারা দেন। রিপন হাওলাদার ও রুবেল খলিফা শুধু নাম পরিবর্তন করে মেসার্স আবির ব্রিকস নামে একই পথে সম্পূর্ন অবৈধভাবে অনুমোদনহীন ইটভাটা চালু করেন এবং নভেম্বর থেকে ইট পোড়ানো শুরু করেন। স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং লোকালয় থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোন ইটভাটা নির্মাণ বা স্থাপন করা যাবে না। এছাড়াও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরির আইনগত নিষেধ রয়েছে। অথচ এসব বিধি-বিধান উপেক্ষা করে কৃষিজমি, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাট-বাজার ও বনাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী স্থানে অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। চৌধুরীর হাটের ব্যবসায়ী মোঃ খবির হোসেন (৬৫) ডাবেরকুল বাজারের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন (৩২), স্থাণীয় আব্দুস সোবাহান (৬০) ও মোঃ লুৎফর রহমান (২৬) অভিযোগ করে বলেন, ক্ষমতার জোরে সম্পূর্ন অবৈধভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু ইটভাটাই চালু করে নাই তারা অবৈধভাবে কৃষি জমির মাটি তুলে ও সন্ধ্যা নদীর তীরের চর কেটে ইট তৈরী করে থাকেন এবং জ্বালনিী হিসেবে কাঠ পোড়ান যা বেআইনি। ইটভাটা বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে কৃষি জমি ও বন উজার হয়ে যাবে।
উজিরপুর মালিকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফৌজিয়া সুলতানা অভিযোগ করে বলেন, ইটভাটা স্থাপনের নীতিমালা অমান্য করে বিদ্যালয়ের একেবারে সন্নিকটে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। চার বছর আগে এ ইটভাটা প্রশাসন বন্ধ করে দিলেও নতুন নামে এ বছর আবারও সেই ইটভাটা চালু করা হয়েছে। এতে ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্বাশকষ্টজনিত রোগ সৃষ্টির আশংকা রয়েছে। স্কুলের পরিবেশ বিপন্ন হতে চলছে। একই অভিযোগ করে বড়াকোঠা ইউনিয়ন মাধ্যমিক ইনষ্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক মারুফা খানম বলেন, ইটভাটায় পরিবেশ দূষনসহ বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে শত ছাত্র ছাত্রী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ইটভাটা বন্ধের জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান তিনি। বড়াকোঠা ইউনিয়ন ডিগ্রি কলেজের (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ শীলা রায় অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘ চার বছর ইটের ভাটা বন্ধ ছিল এতে এলাকার পরিবেশ ভালই ছিল, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না কিন্তু এ বছর আবার ইটভাটা চালু করা হয়েছে। এতে পরিবেশ দূষনসহ শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এ বছর ইটভাটা চালু করেছে মাত্র এক-দেড়মাসে হয়েছে ইতোমধ্যেই বিদ্যালয়ের ভবনের রং বিবর্ন হওয়া শুরু হয়েছে। ভাটা বন্ধ করা না হলে শিক্ষার্থীসহ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মের্স্সা আবির ব্রিকসের প্রোপ্রাইটর রুবেল হাওলাদার অনুমোদনহীনভাবে ইটভাটা স্থাপনের কথা স্বীকার করে বলেন, অনেক পূর্ব থেকেই এখানে ইটভাটা চারু ছিল তাই আমরা পুরানো মালিকের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে পুনরায় চালু করেছি। বৈধ কাগজপত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, কোন কাগজপত্র নেই বা অনুমোদর নেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ীক আরেক অংশীদার রিপন খলিফার কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরানো মালিক সফিকের কাছ থেকে আমরা তিন বছরে জন্য ইজারা নিয়ে নতুন নামে ভাটা চালু করেছি তাই আলাদা কোন অনুমোদন নেইনি যে কারনে এলাকাবাসির অভিযোগ থাকতেই পারে। পরিবেশ দূষন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থাণীয়ভাবে ইটভাটা চালু করায় (কমখরচে) এলাকাবাসির উপকার হচ্ছে সেহেতু কিছু সমস্যাতো মেনে নিতে হবে। উজিরপুর উপজেলা বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ন অবৈধ। লিখিত কোন অভিযোগ পাইনি পেলে সত্যতা যাচাই নিশ্চিত হয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শওকত আলী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা লোকালয়ের পাশে ইটভাটার ফলে শ্বাসকষ্ট, কাশি, এলার্জি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাসকষ্টজনিত রোগ বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে । ধোয়া ধূলা-বালুর পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হলে গোটা এলাকা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে এবং রোগের বিস্তার ঘটবে। এ বিষয় উজিরপুর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে. এম ইসমাম বলেন, অভিযোগ পেয়েছি তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।