গৌরনদী
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ ৬ বছর \ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু পথযাত্রী, অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ প্রতিহিংসার বিরোধের জের ধরে মিথ্যা অভিযোগে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের ৭১‘র রনাঙ্গনের এক মুক্তিযোদ্ধার ৬ বছর ধরে ভাতা বন্ধ রয়েছে। ভাতা বন্ধ থাকায় সমস্ত ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করানোর পরেও অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু পথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান (৬৩)। অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটে পরিবারের সদস্যদের। মুক্তযোদ্ধার আকুতি মারা যাওয়ার পরে ভাতা পেলে তা কোন কাজে লাগবে? তিনি পরিবারের কাছে অছিয়ত করেছেন মারা যাওযার পরে তাকে রাষ্ট্রিয় সম্মান দিলে তা যেন গ্রহন করা না হয়।
সরেজমিমে গিয়ে স্থানীয় লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের সাকোকাঠি গ্রামের পিতামৃত গোঞ্জর আলী খানের ছেলে ইসমাইল খান (৬৩) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে সারা দিয়ে গ্রামের আব্দুল আজিজ ওরফে আজিজ মিলিটারীর অনুপ্রেরনায় ১২০ জনের একটি দল ভারতে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। তারা দেশে দেশে ঢুকে খুলনা, হাসনাবাদ, দেভাটা এলাকায় যুদ্ধ করেন। এ সময় পাক হানাদারে ছোড়া গ্রনেটের স্পীন্টারে আঘাতে তিনি আহত হন। মুক্তিযোদ্ধার লাল বই তার নং-০৬০১১০০২৫৪, গেজেট নং- ৩৪২৩, ভাতা বই নং-এসবি-১১৩১৫, অগ্রনী ব্যাংক, গৌরনদী শাখা।
মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান জানান, মুক্তযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান শুরু থেকেই তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২ হাজার ৪ টাকা ভাতা পান। পরবর্তিতে পর্যায়ক্রমে ১৬ হাজার টাকা ভাতা গ্রহন করেন। ২০১৩ সালে ঢাকায় আওয়ামীলীগ সমর্থিক মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনে তিনি যোগদান করার পরে বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্মিলিত ক্যাপ ও গেঞ্জি পরে বাড়িতে ফিরেন। এ সময় সরিকল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সরিকল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল খান (৬৭) ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন ওই ড্রেস পরে ভাব দেখাস, কয়দিন তোর হাসিনা ক্ষমতায় থাকবে। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল খানের রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধ শুরু হয়। বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষ মোজাম্মেল খান ওই বছর ইসমাইল খানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, ইসমাইল খান একজন মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু যুদ্ধাহত নন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের জুন মাসে বিষয়টি বরিশাল জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্তে জন্য পাঠান। মোজাম্মেল হোসেন খান ও তার সমর্থক মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়ে ইসমাইল খানের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দিলে জেলা প্রশাসকের রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই বছর থেকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ করা হয়।
অসুস্থ্য মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী রেনু বেগম (৫২) জানান, তারা স্বামী স্ত্রী, ছেলে ছেলের বৌ ও দুই নাতিসহ ৬ জনের সংসার। মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকা ও একমাত্র ছেলে জামাল খান রাজ মিস্ত্রির যোগালে কাজ করে সামান্য আয় দিয়ে কোন রকম সংসার চলছিল। ২০১৩ সালে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভাতা বন্ধ হওয়ায় ছেলে আয় দিয়ে সংসার চালানো দায়। ২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা স্বামী লিভার ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় ১৯ শতাংশ জমি থেকে ১৩ শতাংশ জমি বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ চালান। বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ঢাকা সোহয়ারার্দি হাসপাতালে পাঠান। গত ২১ আগষ্ট সোহরয়ার্দি ভর্তি হয়ে কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়া পরে সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে টাকার প্রয়োজন হলে বসত ঘরসহ ৬ শতাংশ জমি বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ যোগান। তাতেও না হলে টাকার অভাবে চিকিৎসা না করিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। বর্তমানে বিক্রি করা বাড়িতে খুবই অসুস্থ্য হয়ে ধুকে ধুকে মরন পথযাত্রী।
সহযোদ্ধা সরিকল গ্রামের আব্দুর রহিম সেপাই (৬৭) বলেন, ইসমাইল খান এজন প্রকৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। শত্রæতা করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেয়ায় ভাতা বন্ধ হওয়ায় অর্ধাহারে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরতে বসেছে। এটা খুবই অমানবিক। গ্রামের জুয়েল (৪৭) জানান, ইসমাইল খান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভিটেমাটি টুকু বিক্রি করে চিকিৎসায় সর্বস্ব খুইয়েছেন। বসত ভিটার দলিল গৃহীতা বাড়ি থেকে বের করে দিলে পরিবার নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে। আজ চিকিৎসা নেই, মুখের খাবার নেই। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার ছেলে জামাল আমার জমি বর্গা চাষ করে করেছিল পরিবারের দুরাবস্থা দেখে ওই জমির সব ধান তাকে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মী নার্গিস আক্তার বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার বসত ঘরসহ শেষ সম্বল ৬ শতাংশ ভিটে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছে কিন্তু মানবিক কারনে অসুস্থ্য মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সেখানে থাকতে দিয়েছি। এমন কি যদি কখনো বন্ধ ভাতার টাকা পান এবং আমার টাকা ফেরত দিতে পারেন তাহলে দেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি জমি ফেরত দিবো। গ্রামের জয়েদা বেগম (৬২) বলেন, পরিবারটি খেয়ে না খেয়ে মানবেতন জীবন যাপন করছে। গত দুই দিনে চুলায় আগুন জ্বলে নাই। আমরা প্রতিবেশীরা কিছু চাল দিলে ভাত রান্না করে খেয়েছে। একই কথা জানালেন গ্রামের মাহিনুর বেগম (৫০)। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে জামাল হোসেন (রাজমিস্ত্রির যোগালে) বলেন, প্রতিদিন কাজ করে মুই সাড়ে ৩/৪ শ টাকা পাই। তা দিয়ে বাবার ঔষাধ কিনব না না খাবার কিনব? মোর দুই ছেলে তৃতীয় ও ৪র্থ শ্রেনিতে পরে। তারাও গ্রামের মানুষের গাছের সুপারি, নারিকেল পাইররা দিয়া ৫০/ ৬০ টাকা আয় করে তা দিয়ে দাদার জন্য খাবার কিনে আনে। অসুস্থ্য মুক্তযোদ্ধা ইসমাইল অঝোড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এ জন্য জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি। বেঁচে থাকতে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছি, না খেয়ে মারা যাচ্ছি। মৃতুর পরে সম্মান দিয়ে কি হবে। রাজনৈতিক বিরোধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ভাতা বন্ধ করে দিয়েছি, মোর জন্য কেউর কিছু করার নাই? ভাতা চালুর জন্য হগোলের ধারে যাইয়া আকুতি করছি কেউ একটু সহানুভতি দেহায়নি। মারা গেলে রাষ্ট্রিয় সম্মান দরকার নাই।
লিখিত অভিযোগ দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন খান বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্মিলিত টুপি ও গেঞ্জি নিয়া বিরুপ মন্তব্য করার কথা অস্বীকার করে বলেন, ও (মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল) একজন প্রকৃত মুক্তযোদ্ধা। ও আমাকে দেড় টাকার মুক্তিযোদ্ধা বলে তিরস্কার করে গালি দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়ার কথা স্বীকার করে অরো বলেন, সে মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু যুদ্ধাহত নন। তদন্তে বিষয়টির সত্যতা পাওয়ায় ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। অপনার একজন সহযোদ্ধা অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না, খাবার পাচ্ছে না এতে আপনার খারাপ লাগে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওর ব্যবহার খারাপ, এখনতো ওর অহংকার কমে না। গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, উর্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশে ভাতা বন্ধ রয়েছে। আমাদের কিছুই করার নেই। তবে বিষয়টি পুনঃ তদন্ত করে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বন্ধ ভাতা চালুর জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে তিনি আবেদন জানিয়েছেন।