গৌরনদী
সরকারি খাল দখল করে ১১ বছর প্রভাবশালীদের মাছ চাষ, অবশেষে বাঁধ কেটে দিল এলাকাবাসি
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কালুরপাড়Ñতালতা সরকারি খালের কালুরপাড় থেকে বারহাজার বরিয়ালী ভায়া কাজিরহাট জলকপাট (ওয়াপদার খাল) পর্যন্ত খালের মাঝে প্রায় আড়াই কিলোমিটর জায়গা দখল করে ১১ বছর ধরে অবৈধ বাঁধ দিয়ে মাছ করে আসছিল এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী। এতে বোরো চাষী, মৎস্যজীবিসহ খাল পাড়ের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ জিম্মি হয়ে পরেছিল। বিভিন্ন সময় অবৈধ বাঁধ অপসারনের দাবি করা হলেও কোন কাজ হয়নি। অবশেষে বিক্ষুব্ধরা বাঁধটি কেটে অপসারন করেছে। বাঁধটি অপসারন করায় খাল পাড়ের প্রায় অর্ধ লাখ মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে ভূক্ত ভোগী কৃষক, এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহনের পরে আগৈলঝাড়া উপজেলার নগরবাড়ি গ্রামের প্রভাবশালী ও আগৈলঝাড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য গোলাম মূর্তজা খান (৫২), এনায়েত হাওলাদার (৫০), আনোয়ার হোসেন খান (৫৮) ও উপজেলা শ্রমিকলীগের সদস্য শামীম খান (৪৮)সহ ১০/১২ কালুরপাড়Ñতালতা সরকারি খালের আড়াই কিলোমিটারে পশ্চিমে নগরবাড়ি সরু খাঁনের বাড়ির সামনে এবং পূর্বে প্রশান্ত ডাক্তারের বাড়ির সামনে দুটি বাঁধ নির্মান করে মাছ চাষ করে আসছিল।
স্থাণীয়রা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহনের শুরুতেই উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও নগরবাড়ি গ্রামের গোলাম মূর্তজা খান। তার নেতৃত্বে তার একান্ত সহযোগী এনায়েত হাওলাদার, শামীম খান, আনোয়ার খানসহ ১০/১২ জন নেতাকর্মী খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। ওই সময় এলাকাবাসি তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বাঁধ না দিতে অনুনয় বিনয় করলে কোন কাজ হয়নি। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকায় দাপটের সঙ্গে সরকারি খালে বাঁধ দিয়ে মাছ করেছেন। সরকারি খালটি বাঁধ দেয়ায় গত ১১ বছর ধরে সেচ সংকটে খাল পাড়ের ৭০/৮০ টি বোরো প্রকল্প বন্ধ হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার বোরো চাষী। জীবিকা নির্বাহ করতে পারেনি ৫ শতাধিক মৎস্যজীবি। খালে পানি ব্যবহারসহসহ সুবিধাবঞ্চিত ছিল ১০টি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। খালে পানি ব্যবহার করতে গেলে নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হত এলাকাবাসি।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আগৈলঝাড়া উপজেলার কালুরপাড়Ñতালতা সরকারি খালের নগরবাড়ি সরু খাঁনের বাড়ির সামনে এবং পূর্বে প্রশান্ত ডাক্তারের বাড়ির সামনে প্যালাসাইডিং ও ড্রামসিট দিয়ে ৩/৪ শত মিটার প্রস্থ বিশাল আকারের স্থায়ী বাঁধ দুটি কেটে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ কৃষক, মৎস্যজীবি ও এলাকাবাসি। ১১ বছর পর এলাকাবাসির মরন ফাঁদ অবৈধ বাধ অপসারন করায় সকলের আনন্দ ও উচ্ছাস। এ সময় রামের বাজার গ্রামের ইয়াছিন সরদার (৪৫), ঘোড়াপাড় গ্রামের পারুল রানী (৪২) ) রাহুত কাঠী গ্রামের অবিনাশ হালদার (৩৮)সহ কয়েকজন উল্লাস প্রকাশ করে বলেন, সরকারি খালে অবৈধ বাঁধ দেয়ায় খালের পাড়ের দুই পাশের শত শত পরিবার খালের পানিতে ধোয়া পাকলা, অজু, গোসল, খাবারসহ পরিবারের নিত্য নৈমত্তিক কাজ করা থেকে ১১ বঞ্চিত ছিল। বাঁধ অপসারন করে দখলমুক্ত হওয়ায় অনুভূতি বলে বুঝাতে পারবো না। ১১ বছর বাঁধ থাকায় কৃষকসহ হাজার হাজার মানুষের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখবো ও জীবন শুরু করবো। জানে আলম (৩৫) বলেন, জনগনের গণ দাবি উপেক্ষা করে বাঁধ প্রভাবশালীরা ক্ষমতার প্রভাবে অবৈধ বাঁধ দিয়ে ১১ বছর সাধারন মানুষ জিম্মি করে রেখেছিল, আজ সেই ক্ষতিগ্রস্থ নির্যাতিতরা নিজেরই বাঁধ অপসারন করেছে। সরকারি খালের পানি ব্যবহারের বাধা দেয়া হত। বাঁধের মধ্যে থাকা খালের পানি হাত পা ধুতে গেলেও মাছ চুরির অভিযোগ দিয়ে সাধারন মানুষকে নির্যাতন করা হত।
মৎস্যজীবি কাঠিরা গ্রামের অনিল বৈদ্য (৫৫) সুনীল হালদার (৪২)সহ অনেকেই জানান, বাপ দাদার আমল থেকে তারা খালে জাল ফেলে মাছ ধরে, ভেসাল পেতে, গড়া দিয়ে মাছ ধরে তা বিক্রি করে পরিবার পরিজনের জীবিকা নির্বাহ করতেন কিন্তু ১১ বছর তা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছি। গ্রামের শত শত মৎস্যজীবি পেশা ছেড়ে দিয়েছিল। আমরা আবার নতুন করে খালে জাল ফেলতে পারবো।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য গোলাম মূর্তজা খান বলেন, মাছ চাষে আমি ছিলাম না। তাছাড়া ওই বাঁধ ৫/৬ বছর আগে অপসারন করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে এনায়েত হাওলাদার বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউএনওর নির্দেশে এলাকাবাসি বাধ অপসারন করেছে বলে শুনেছি। শ্রমিকলীগের সদস্য শামীম খান বলেন, বাঁধ অপসারনের কথা শনেছি। গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোঃ মশিউর রহমান বলেন, সরকারি খালে প্রভাবশালীদের অবৈধ বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করায় ১১ বছর হাজার হাজার মানুষ জিম্মি ছিল। ক্ষতিগ্রস্থরা জেগে উঠেছে তারা নিজেরাই বাঁধ অপসারন করেছে। গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, অবৈধ বাঁধে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন তারা জিম্মি ছিল। সাধারন মানুষ অবৈধ অপসারন করায় খাল তার নিজস্ব গতি ফিরে পেয়েছে। পাশাপাশি সরকারি খালে সাধারন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপুল চন্দ্র দাস বলেন, দীর্ঘ দিন প্রভাবশালীরা সরকারি খাল দখল করে মাছ করায় কৃষক ধান চাষ করতে পারছে না, এলাকাবাসি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই মর্মে তারা বাঁধ অপসারন চেয়ে আবেদন করলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিলে প্রশাসনের সহায়তায় ভূক্তভোগী ও সাধারন মানুষ বাঁধটি অপসারন করেছে।