গৌরনদী
উজিরপুরে ইউপি চেয়ারম্যান হত্য \ এক বছরে অভিযোগপত্র দিতে পারেনি, স্বাক্ষী ও শতাধিক স্বজনদের বিরুদ্ধে ৫ মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীন বিরোধ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র গত বছর এইদিনে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ হালদারকে (৪৫) উপর্যপুরি গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাতনামা দূবৃত্তরা। বহুল আলোচিত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার হত্যাকান্ডের এক বছর পেরিয়ে গেলেও আদালতে মামলার চার্জশিট জমা দিতে পারেনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উজিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ হেলাল উদ্দিন। এদিকে হত্যা মামলার আসামিদের দায়ের করা ৫ মামলায় আসামি হয়েছেন হত্যা মামলার স্বাক্ষী. নিহতের স্বজনসহ শতাধিক ব্যক্তি। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন নিহতের পরিবার ও স্বজনরা।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন, বন্দরের ব্যবসায়ী, নিহতের পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মি ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাতে উপজেলার কারফা বাজারে নিজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে জনসম্মুখে বিশ্বজিৎ হালদারকে (৪৫) উপর্যপুরি গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাতনামা দূবৃত্তরা। ওই দিন রাতে (২১ সেপ্টেম্বর) নিহতের বাবা মুক্তিযোদ্ধা সুখ রঞ্জন হালদার বাদি হয়ে তৎকালীন বরিশাল-২ আসনের সাংসদ তালুকদার মো. ইউনুসের একান্ত সচিবসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০ জনকে আসামি উজিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার বাদি নিহতের বাবা মুক্তিযোদ্ধা সুখ রঞ্জন হালদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ছেলে হত্যা করেছে এক পেরিয়ে গেলেও এখনো আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকান্ডের পর পর পুলিশ কতিপয় আসামিদের গ্রেপ্তার করলেও পরবর্তিতে কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গ্রেপ্তারকৃতরা জামিনে বের হয়ে মামলা প্রত্যাহারে জীবননাশসহ বিভিন্নভাবে ভয়ভীি দেখিয়ে হুমকি দিচ্ছে। এমন কি স্বাক্ষীদের বিরুদ্ধে একের পর মামলা করেছে আসামি ও তাদের স্বজনরা। নিহতের স্ত্রী জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেবী হালদার স্মৃতিচারন করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার স্বামী ছিল এলাকার মানুষের মাথার মনি। দলমত নির্বিশেষে তাকে মানুষ ভালবাসতো। দলীয় পরিচয়ে গড়ে উঠা মাদক সিন্ডিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। দীর্ঘ এক বছরেও মামলার কোন কুল কিনারা করতে পারেনি। আজকে আমি তার (স্বামীর) চেয়ারটিতে বসি কিন্তু এ বসা আনন্দের চেয়ে বেশী পীড়াদায়ক। পরিষদে বসে কাজ করার প্রতিটি মুহুর্তই আমাকে কষ্ট দেয়। তারপরেও সব ভুলে প্রিয় মানুষটির অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে কাজ করে যাচ্ছি। স্বামীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমার একটাই দাবি অনতিবিলম্বে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ফাঁসি কার্যকর করা হোক।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উজিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ হেলাল উদ্দিন জানান, বহুল অলোচিত ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার হত্যাকান্ডের সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে। হত্যাাকান্ডে জড়িত এজাহার নামীয় আসামি জল্লা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ও জল্লা ইউনিয়ন স্বেচ্ছসেবকলীগের সভাপতি তাইজুর রহমান, ঢাকা মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মা. শাকিল ইসলাম ওরফে রাব্বি, উজিরপুরের জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন শাহ, ইউপি চেয়ারম্যানকে গুলিকারী রবিউল আলম, উজিরপুরের শোলক চেয়ারম্যান কবির কাজী, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতা হরষিত রায়, আইয়ুব হোসেন, জগদীস বাড়ৈ, তার পুত্র খোকন বাড়ৈ, সাইদুল ইসলাম, মান্নান হাওলাদার, রমনী জয়ধর, আয়নাল হক ভদ্দর, লিটন হাওলাদার, দীলিপ চৌধুরী, কাউসার সেরনিয়াবাত, কুদ্দুস হাওলাদার, হাদীরুল ইসলাম, মো.দিপু ও মো. সোহাগ হাওলাদারসহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে হত্যা রহস্য ও হত্যাকান্ডে জড়িতদের সনাক্ত করা হয়েছে। চেয়ারম্যানকে সরাসরি গুলি করে হত্যাকারী রবিউল আলম গত ১২ নভেম্বর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। খুব শ্রীঘ্রই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যা যা করনীয় সবই করা হচ্ছে।
নিহত ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদারের ভাতিজা অলক হালদার (২৮) অভিযোগ করে বলেন, আসামিরা জামিনে বের হয়ে হত্যা মামলা প্রত্যহারে বাদি ও স্বাক্ষিদের প্রাননাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে হুমকি দিচ্ছে। আসামি কাওছার সেরনিয়াবাত সন্ত্রাসীদের নিয়ে সশস্ত্র মহাড়া দিয়ে স্বাক্ষীদের মনে আতংক সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয় হত্যা মামলার আসামি ও তাদের স্বজনরা হত্যা মামলার স্বাক্ষী ও স্বজনসহ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে ৫ টি মামলা দিয়ে হয়রানী করছে।
আদালত ও থানা সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার পরে বিক্ষুব্ধ জনতা কারফা বাজারের কয়েকটি দোকান ও বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এ ঘটনায় হত্যার ৯ মাস পর গত ১৬ জুন হত্যা মামলার এজাহারভূক্ত আসামি উপজেলার বিলগাববাড়ির রমেশ হালদার বাদি হয়ে স্বাক্ষী নিহত চেয়ারম্যানের বিভিন্ন কাজের তদারককারী ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সদস্য দুলাল বিশ্বাস, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সদস্য চেয়ারম্যানের সমর্থক মো. মিজান হাওলাদার, ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য পংকজ জয়ধর, মিন্টু বাড়ৈ, জল্লা ইউনিয়ন ৮নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন সিকদারসহ ১৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামাসহ ৪০ জনকে আসামি করে বরিশাল সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করেন। এর আগে কারফা বাজার সংলগ্ন তিনতলা পাকা ভবনের ৯টি ফ্লাটে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট করে প্রতিটি তালায় পেট্রোলের ব্যারেল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় বাহেরঘাট গ্রামের সৌদী প্রবাসী খোকন সরদারের স্ত্রী ঝুমুর আক্তার বাদি হয়ে একটি, বাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ সরদারের স্ত্রী নুসরাত আক্তার বাদি হয়ে একটি, বাজারের দোকানপাট ভাঙচুর-লুটের ঘটনায় ব্যবসায়ী সাইদুল বাদি হয়ে পৃথক ২টিসহ ৫টি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলায় শতাধিক আসামি রয়েছে। মামলাগুলো তদন্তাধীন রয়েছে।
উল্লেখ্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র গত এক বছর ধরে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান ও বরিশাল-২ আসনের সাংসদ আইনজীবি তালুকদার মো. ইউনুসের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। দুই নেতার বিরোধ দলের তৃনমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ.লীগ সভাপতি বিশ্বজিৎ হালদার উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের এবং জল্লা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ও জল্লা ইউনিয়ন স্বেচ্ছসেবকলীগের সভাপতি তাইজুল ইসলাম সাংসদ তালুকদার মো. ইউনুসের অনুসারি ছিলেন। জল্লা ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার ও তাইজুল ইসলামের চরম বিরোধ তৈরী হয়। এ বিরোধেকে কেন্দ্র করেই ইউপি চেয়ারম্যান হত্যার ঘটনা ঘটে। এ হত্যাকান্ডের কারনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সাবেক সাংসদ তালুকদার মো. ইউনুস ও উপজেলা নির্বাচনে সাবেক উপজেলা চেয়ার্যমান মোঃ হাফিজুর রহমান মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন।