প্রধান সংবাদ
বন্ধু ভয়ঙ্কর!
ফাহিম মুরশেদঃ দেশের মাদকসাক্তদের মধ্যে ৩০ বছরের ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। এ সংখ্যা ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ। বেশির ভাগ মাদকাসক্তই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্ররোচণায় পড়ে আসক্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বন্ধুর প্ররোচণায় পড়ে প্রথম মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেছে ৭৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১৫ সালের এই হারটি ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি। বাড়ছে শিশু মাদকাসক্তের সংখ্যাও। গত বছরের রোগীর মধ্যে ছিল ৫ দশমিক ৭৬; যা আগের বছর ছিল ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বাড়ছে মাদকাসক্তের হার যা ২০১৪ সালে ছিল ৯ দশমিক ৭২ এবং গত বছর বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ শুধুমাত্র ইয়াবা সেবন করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৫) এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার ২৬ জুন দেশে ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ পালিত হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৬ জুন সারা বিশ্বে মাদকবিরোধী দিন হিসেবে ব্যাপক কর্মসূচী পালিত হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়ও হচ্ছে- ‘আগে শুনুন : শিশু ও যুবাদের প্রতি মনোযোগ দেয়াই হলো তাদের নিরাপদ বেড়ে উঠার প্রথম পদক্ষেপ।’
এ দিবসে প্রকাশের জন্যই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ডিএনসি, যা মঙ্গলবার ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিতব্য সভায় উপস্থাপন করা হবে।
ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) খন্দকার রাকিবুর রহমান বলেন, ‘মাদকের হাত থেকে শিশু ও উঠতি বয়সের তরুণদের রক্ষা করা এবং মাদকের সহজলভ্যতা হ্রাস করাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্য এনালাইসিস করে আরো কাজ করতে হবে। দেশের ৩৭ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিটি এলাকায়ই মাদকবিরোধী কাজ করা আমাদের লক্ষ্য।’
তিনি আরো বলেন, ‘অভিযানও চালানো হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি চাহিদা হ্রাসকে।’
মাদকবিরোধী দিবস উপলক্ষে ডিএনসির তৈরি করা বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে, গত বছর মাদকাসক্ত রোগীদের মধ্যে যারা চিকিৎসা নিয়েছে তাদের ৭৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়েছে। এই হার প্রতি বছর বাড়ছে। ২০১৪ সালে ছিল ৬৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬০ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৬১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এরপর মাদকাসক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে কৌতুহলে পড়ে। গত বছর এ হার ছিল ১৮ দশমিক ৩; ২০১৪ সালে ২৪ দশমিক ৫৬; ২০১৩ সালে ৩২ দশমিক ৭ এবং ২০১২ সালে ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
প্রতি বছরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকাসক্তির হার বাড়ছে। গত বছর ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ মাদকাসক্ত ছিল শিক্ষর্থী, যা ২০১৪ সালে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০১৩ সালে ৮ দশমিক
৯৮ এবং ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৩।
পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে মাদকাসক্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হল বেকার। গত বছর এই হার ৪১ দশমিক ৮৪ এবং ২০১৪ সালে ছিল ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ ও ২০১২ সালে ছিল যথাক্রমে ৪৪ দশমিক ১৪ ও ৫৩ দশমিক ২৭।
গত বছর মানসিক অশান্তির কারণে শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ মাদকে আসক্ত হয়। আর পারিবারিক কারণে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৬ থেকে ৩০ বছরের রোগীর সংখ্যাই বেশি। গত বছরের পরিসংখ্যানের ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশই এই বয়সের। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ২১ থেকে ২৫ বছরের যুবারা। এই হার গত বছর ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২০ দশমিক ১১; ২০১৩ সালে ২১ দশমিক ৭৩ এবং ২০১২ সালে ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
গত বছর ১৫ বছরের মধ্যে শিশু মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ; ২০১৪ সালে ছিল ৩ দশমিক ১০, ২০১৩ সালে ১ দশমিক ২২ এবং ২০১২ সালে ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
গত বছর ১৬ থেকে ২০ বছরের মাদকাসক্ত রোগী পাওয়া গেছে ৯ দশমিক ৫৭; ২০১৪ সালে ১৩
দশমিক ৭৭; ২০১৩ সালে ১২ দশমিক ১৬ এবং ২০১২ সালে ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।
মাদকাসক্তদের ১৯ দশমিক ১৪ শতাংশ শুধুমাত্র ইয়াবায় আসক্ত। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭
দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে ১০ দশমিক ৩৩ এবং ২০১২ সালে ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি কমছে ফেনসিডিল আসক্ত রোগীও। গত বছর এ ক্যটাগরির রোগী ছিল ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ; যা ২০১৪ সালে ছিল ৪৩ দশমিক ১৮ শতাংশ; ২০১৩ সালে ৫৪ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৭২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, গত বছর দেশের সরকারি চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নয় হাজার ৪৭৪জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে বহিঃর্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে সাত হাজার ২৬৬জন এবং ভর্তি করা হয় দুই হাজার আটজনকে। এক বছরে দেশের শতাধিক অনুমোদিত বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ছয় হাজার ৯১২জন মাদকাসক্ত রোগী। এ হিসাবে বছরে ১৬ হাজার ৩৮৬জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রতি বছরই একই সংখ্যাক অভিযান : ডিএনসির প্রতিবেদন অনুযায়ী অধিদপ্তর গত বছর ১১ হাজার ৩০০ জন মাদক বিক্রেতার বিরুদ্ধে ১০ হাজার ৫৪৮টি মামলা করে। উদ্ধার করা হয়- ৩৩ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট; ১১ দশমিক ৩০২ কেজি হেরোইন, পাঁচ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেন, গাঁজা চার হাজার ৪৫৫ কেজি, গাঁজা গাছ ৪৭টি, কোডিন মিশ্রিত ফেন্সিডিল ৩০হাজার ৮১৮ তল, কোডিন মিশ্রিত খোলা ফেনসিডিল ৩৮৩ দশমিক পাঁচ লিটারসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য।
অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত চার বছর প্রায় একই সংখ্যাক মামলা করছে ডিএনসি; গড়ে ১০ হাজারের কিছু বেশি। ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৭২৩ মামলায় ১২ হাজার ৫৯০জনকে আসামি করা হয়। ২০১৩ সালে ১০ হাজার ১১১ মামলায় আসামি ১০ হাজার ৯৯০ এবং ২০১২ সালে ১০ হাজার ১৪ মামলায় আসামি ১১ হাজার ৪০জন।
গত বছর ১৪ হাজার ৯৩৭টি ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে সাত হাজার ৪৮৭ মামলায় সাত হাজার ৮২৩ আসামিকে দণ্ড দেয়া হয়। ২০১৪ সালে ১৪ হাজার ৮১৫ অভিযানে সাত হাজার ৯৪৮ মামলায় আট হাজার ৩২০ জনের দণ্ড দেন ভ্রাম্যমান আদালত।
বেড়েছে মাদকবিরোধী প্রচারণা : তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় চলতি বছর সচেতনতামূলক কার্যক্রম কয়েকগুণ বাড়িয়েছে ডিএনসি।
প্রকাশিতব্য বার্ষিক প্রতিবেদন ও সাময়িকীতে বলা হচ্ছে, গত বছর দেশের ৮০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হযেছে। ২০১৪ সালে কমিটি করা হয় ৩০৯টি। তবে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের ২১ হাজার ৮৩টি প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি গঠন করা হয়। মূলত গত বছরের ১৮ নভেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠনের রূপরেখা ও সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিধি উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর অফিস আদেশ জারি করলে ব্যাপকভাবে কমিটি গঠন শুরু করে ডিএনসি।
অধিদপ্তরের প্রকাশনার তথ্যমতে, ২০১৪ সালে মাদকবিরোধী পোস্টার তৈরি করেছে পাঁচ হাজার, ২০১৫ সালে ৩৪ হাজার পাঁচশ’ এবং চলতি বছরের ছয় মাসেই এক লাখ ছাড়িয়েছে। গত দুই বছরে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার। আর চলতি বছরের ছয় মাসে তা করা হয়েছে সাত লাখ ৯৮ হাজার। দুই বছরে স্টিকার সাটানো হয়েছে ২৪ হাজার পাঁচশ’।
এবারের ছয় মাসে তা হয়েছে ১৭ হাজার। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে মাদকবিরোধী আলোচনা সভা ও সেমিনার হয়েছে ৯ হাজার ৫৯৪। এ বছরের প্রথম চার মাসে করা হয়েছে দুই হাজার ৬৬৪টি। স্কুল-কলেজে মাদকবিরোধী বক্তৃতা হয়েছে দুই বছরে এক হাজার ৪৫৯টি। আর এ বছরের প্রথম চার মাসেই হয়েছে পাঁচশ’ ২৪টি। দুই বছরের সাময়িকী প্রকশনা হয়েছে তিন হাজার। এবার প্রথম চার মাসেই দেড় হাজার। গত জানুয়ারি মাসে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় মিনি প্যাভিলিয়ন স্থাপন করে মাসব্যাপী মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়েছে, যা এবারই প্রথম। জানুয়ারিকে মাদকবিরোধী প্রচারণার মাস ঘোষণা করে ব্যাপক কর্মকাণ্ডও চালায় অধিদপ্তর। এসময় ৫১৭ মাদকবিরোধী আলোচনা সভা; ১৫৬টি র্যালি ও মানববন্ধন; ৩২৮টি গণস্বাক্ষর অভিযান; ৩২টি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; ২৭টি সড়কদ্বীপ সাজসজ্জা; ২২১টি চলচ্চিত্র প্রদর্শন; ১২৮টি মাদকবিরোধী মাইকিং এবং ৪৪৮টি অভিযান চালানো হয়।