গৌরনদী
দুই করোনা জয়ী নারীর গল্প, অবহেলা নয়, ভালবাসাই সুস্থ্য হতে সাহায্য করে
জহুরুল ইসলাম জহির,
অবহেলা নয়, ভালবাসোই একজন করোনা রোগীকে সুস্থ্য হতে সাহায্য করে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন মানুষের ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মীতা ও ভাল আচরন। করোনা জানি কোন মানুষের হয় না। করোনায় মানুষ মরে না, করোনা আক্রান্ত মানুষ মরে সমাজের মানুষের ঘৃনা ও অপবাদের ভয়ে, অবহেলা ও মানুষিক অত্যাচারে। কথাগুলো বলছিলেন করোনা জয়ী গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র র্নাস দুলুফা খানম (৪৭) ও করোনা জয়ী উজিরপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স পাপড়ি বাড়ৈই (২৭)। সুস্থ্যে হয়ে কর্মস্থলে যোগদান করেছে ওই দুই করোনা জয়ী নারী।
গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র র্নাস দুলুফা খানম জানান, সামান্য শ্বাসকষ্ট ও কাসি দেখা দেয়ায় গত ৪ মে করোনা পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নমুনা দেই। ৬ মে পরীক্ষার রিপোর্টে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়। ওই দিন (৬ মে) অফিস করে বাড়িতে ফেরার পরে বিকেলে ফোনে করোনা পজেটিভ হওয়ার বিষয়টি জানতে পান। করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে এবং হাসপাতালে নমুনা দিতে আসা ব্যক্তির সংস্পর্শে থেকে তিনি আক্রান্ত হন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার করোনা পজেটিভ বিষয়টি স্থানীয়ভাবে জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমার পরিবারের উপর কাল বৈশাখী মহাতান্ডব শুরু হয়েছে। আমার কপালটা যেন কেমন হয়ে গেল।ওই দিন রাতেই একদল বখাটেরা বাসার সামনে লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে দিয়ে যা তা ভাষা ব্যবহার করে গেল। শুরু হল আমার ও পরিবারের সদস্যদের মুঠোফোনে এলাকাবাসির অত্যাচার।বিশ্রী ভাষায় গালাগাল, ঘৃনা, অপবাদ। বাসার সামনে এসে ধিক্কার দেওয়া এবং বিভিন্ন চায়ের দোকানের আড্ডায় আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দুর্বব্যাবহার জীবনকে অতীষ্ট করে তুলছে।চেনা জানা এলাকা যেন অচেনা নগরীতে পরিনত হল।পরে বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রব হাওলাদারকে অবহিত করার পরে তিনি পদক্ষেপ নেয়ায় কিছুটা কাজ হল। “কোন মানুষের যেন করোনা না হয়। করোনায় মানুষ মরে না, করোনা আক্রান্ত মানুষ মরে সমাজের মানুষের ঘৃনা, অবহেলা ও মানুষিক অত্যাচারে”।সাধারন মানুষ যাই করুক না কেন। আমার উর্ধর্তন কতৃপক্ষর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। স্যারেরা আমার সার্বক্ষনিক খোজখবর নিয়েছে, মনোবল ও সাহস যুগিয়েছে।যা করোনা আক্রান্ত রোগীর সুস্থ্যতার জন্য খুবই প্রয়োজন। স্বামীর সেবায় আমি মুগ্ধ। অসুস্থ্যকালীন ১৬/১৭ দিনে তিনি দিনে ৪/৫ বার গরম পানির ভাব নেওয়া, গরম-পানি, চা খাওয়া ভিটামিনযুক্ত ফলমুল খাওয়াসহ সার্বিক সেবা প্রদান করেছেন।
করোনা জয়ী দুলুফার স্বামী বাটাজোর সুইস হাসপাতালের পরিচালক সাজ্জাত হোসেন (৫৫) তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার পরিবারের প্রতি সমাজের মানুষের এত ভালবাসা-সম্মান ছিল কিন্তু করোনা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্তেই সব যেন হারিয়ে গেল। মানুষের সহানুভূতির পরিবর্তে পেয়েছি অবজ্ঞা, লাঞ্চনা। যা স্মরনীয় হয়ে থাকবে।তিনি আরো বলেন, করোনা রোগে রোগীকে যতটা দূর্বল বা ক্ষতি না করে তার চেয়ে বেশ করে ঘৃনা আর অবহেলায়। আমার ধারানা করেনায় আক্রান্ত বেশীরভাগ রোগী ঘৃণা ও অবজ্ঞায় হৃদযন্ত্রের ক্রীয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।
সুস্থ্য হওয়ার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুলুফা বলেন, যতটা অপমান-লাঞ্চিত হযেছি তার চেয়ে বেশী সম্মান পেয়েছি। তাই পূর্বের কষ্ট ও বেদনার কথা ভূলে গেছি।করোনা রোগীর প্রতি অবহেলা -অবজ্ঞা নয়, ভালবাসার জন্য সমাজের মানুষের প্রতি তিনি আহবান জানান। গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আমরুল্লাহ বলেন, রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে সিনিয়র নার্স দুলুফা খানম করোনায় আক্রান্ত হন। তাই জয়ী করেনা যোদ্ধা হিসেবে তার জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যাতে করেনা রোগীর প্রতি সেবা প্রদানে সেবিকাসহ মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরনা সৃষ্টি হয়।
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শওকত আলী জানান, বরিশালের মধ্যে স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে বেশী করোনা আক্রন্ত রোগীর চিকিৎসা হয় উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এখানে ৬জন করোনা আক্রন্ত রোগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করা হয়েছে।হাসপাতালের আইসোলেশন বিভাগে এসব রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে নার্স পাপড়ি বাড়ৈ (২৭) সংক্রমিত হন।নিজ বাসায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হন।গত ২১মে একাধিক রিপোর্টে তার করোনা নেগেটিভ আসে। করেনা যুদ্ধে জয়ী করোনা যোদ্ধা হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উদ্যোগে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স করেনা জয়ী পাপড়ি বাড়ৈ বলেন, আমার করোনা শনাক্ত হওয়ার পরে সামাজিক বৈষম্য-বিরুপ আচরন আর অবজ্ঞার ভয়ে আমি ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। জীবন মৃত্যু নিয়ে এক অজানা হতাশায় নিমজ্জিত হই।মনের ভীতরে এক ধরনের মৃত্যু ভয় কাজ করতে থাকে। তখন আমার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শওকত আলী স্যারসহ সহকর্মীরা আমাকে খুবই সাহস যুগিয়েছে। তিনি সব সময় খোজ খবর নিয়ে মনোবল দৃড় করেছে।স্যারের দেয়া সাহস ও পরামর্শ ধীরে ধীরে আমার মনে পরিবর্তন এসেছে।অনেকটা মনোবল ফিরে পেয়েছি। “করোনা রোগীর সুস্থ্যতার জন্য আশপাশের মানুষের ভালবাসা ও মনের শক্তি যোগানো অনুপ্রেরনামূলক কথা মনের শক্তিকে বৃদ্ধি করে এবং সুস্থ্য হতে সাহায্য করে। মনের সাহস যোগানো কথা ও গরম পানির ভাব নেওয়া, আদা, লেবু, লবঙ্গ চা খাওয়া ঔষাধের চেয়ে বেশী কাজ করে। সমাজের কিছু লোক সব সময়ই সব কিছু (করেনা)খারাপ চোখে দেখেন কিন্তু আমি আক্রান্ত হওয়ার পরে বস, সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন ও বাড়ির আশ পাশের অধিকাংশ লোকের ভালবাসা ও সহানুভূতি বেশী পেয়েছি যে কারনে আমি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সুস্থ্য হয়েছি। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন মানুষের ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মীতা ও ভাল আচরন। আত্রান্ত রোগীর প্রতি মমতা-ভালবাসা ও সহানুভূতি জানানোর জন্য তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান।