গৌরনদী
একটানা আড়াই মাস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন করোনা যোদ্ধা বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ বৈশ্বিক মহামারি করোনা যুদ্ধে একটানা আড়াই মাস সেবা দিয়ে করোনা যুদ্ধে বীর হিসেবে খ্যতি অর্জন করেছে বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলোজিষ্ট বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ (৩৬)। সকল ভয়ভীতি কাটিয়ে একাই গত আড়াই মাসে ২শর বেশী করোনা উপসর্গে থাকা ব্যক্তির স্যাম্পল সংগ্রহ করেছেন বিভূতি রঞ্জন। তার মধ্যে ১২জন করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। ১৩ মার্চ নববিবাহিত করোনাযোদ্ধা বিভূতি রঞ্জন স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে বাড়িতে রেখে নিজে উপজেলা সদরের ডাক বাংলায় আলাদা থেকে তিন মাস বিরতিহীনভোবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষকে সেবার জন্যই জীবন, আর এ জীবনকে সেবার কাজেই উৎসর্গ করতে চান করোনাযোদ্ধা বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ। শুধু তাই নয় এই পরিবারের ৭জন সদস্যই কারেনা যুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স হিসেবে করোনা রোগীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের বাহেরঘাট গ্রামের মৃত অম্বিকা রঞ্জন বাড়ৈ একজন পল্লি চিকিৎসক ছিলেন। বরিশাল জেলার প্রত্যন্ত পল্লি অঞ্চলের চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষকে প্রায় ৬০ বছর পল্লি চিকিৎসক হিসেবে গ্রামবাসিকে সেবা দিয়ে মারা যান। মানুষকে সেবা দেয়ার মানুষিকা থেকে তিনি তার সকল ছেলে মেয়েকে চিকিৎসা সেবক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে পরিবারের ৭ সদস্য করেনা যোদ্ধা হিসেবে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন।
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলোজিষ্ট বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ জানান, দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ১/২ দিন পরে গত ১৩ মার্চ তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের দুই দিন পরেই ১৫ মার্চ করোনা যোদ্ধা হিসেবে কাজে যোগ দিতে হয়েছে। ওই সময় উজিরপুরসহ সারা দেশে করোনা আতঙ্ক চলছিল। ইটালী, চীন, আমেরিকা ও সৌদীসহ প্রবাসীরা গোপনে উজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিল। করোনা উপসর্গ নিয়ে থাকা ব্যক্তিদের স্যাম্পল সংগ্রহ করার প্রয়োজন হলে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা ভয়ে স্যাম্পল আনতে রাজি হতেন না। তখন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ শওকত আলী নিজেই ভয়ভীতি ফেলে তাকে (বিভূতি)নিয়ে ১২ জনের স্যম্পল সংগ্রহ করেন।
বিভূতি রঞ্জন বলেন, প্রথম দিকে স্যারের সঙ্গে ১২ জনের স্যম্পল সংগ্রহ করার পরে আমার মধ্যে সংকোচ দ্বিধা-ভয় কেটে যায়। সেই থেকে গত আড়াই মাসে আমি একাই ২শ ১০ জনের করোনা উপসর্গে থাকা ব্যক্তির স্যাম্পল সংগহ্র করেছি। যার মধ্যে এ পর্যন্ত ১২ জনের শরীরে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। গত অড়াই মাসে আমি এক দিনও ছুটিতে যেতে পারিনি। করোনা চিকিৎসার নীতিমালা অনুযায়ি ১৪ দিন দায়িত্ব পালনের পরে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টি থাকার নিয়ম থাকলেও কাজের চাপে আমি সে সুযোগ পাইনি।আমার বাড়ি গ্রামাঞ্চলে হওয়ায় গত আড়াই মাস দিন রাত টানা কাজ করার কারনে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও উজিরপুর প্রশাসন আমাকে উজিরপুর উপজেলা সদরের সরকারি ডাক বাংলায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।সেখানে থেকেই দায়িত্ব পালন করছি।
নব বিবাহিতা স্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভূতি রঞ্জন বলেন, দেশে যুদ্ধে শুরু হলে স্ত্রী কিংবা পরিবারের মায়ায় দেশ প্রেমিক কোন সৈনিক ঘরে থাকতে পারে না। তেমনি দেশে করোনা যুদ্ধ শুরু হলে দেশের প্রয়োজনে মানুষকে বাঁচাতে একজন করোনা যোদ্ধা হিসেবে নব-বিহাহিতা স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে বাড়িতে ফেলে যুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছে। মানুষকে সেবার জন্যই জীবন, আর করোনা যুদ্ধে এ জীবনকে সেবার কাজেই উৎসর্গ করতে চাই। দেশের ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মী হিসেবে শতভাগ উজার করে সাধ্যমত জনসাধারণকে সেবা প্রদানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । এই মুহুর্তে স্ত্রী-পরিবার আমার কাছে তুচ্ছ। বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈর নব-বিবাহিতা স্ত্রী সার্থী হাওলাদারের কাছে স্বামী সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বামীকে নিয়ে আমি গর্ব বোধ করি। কারন সে (স্বামী) মানুষকে বাঁচাতে দেশের প্রয়োজনে একজন দায়িত্বশীল স্বাস্থ্যকর্মী করোনাযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই দিক থেকে দায়িত্বশীল একজন স্বামী পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।বেঁচে থাকলে বিজয়ী যোদ্ধা বেশে সে ফিরে আসবে। আপনারা আমাদের জন্য আর্শিবাদ করবেন। বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈর বৃদ্ধা মা কাজলী রানী বাড়ৈ (৭৫) ছেলে মেয়েদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, উনিই তো ওদের মানুষকে সেবা দিতে শিখিয়ে গেছেন।ছেলে মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও ওদের বাবার কথা মনে করলে আর ভয় থাকে না। দেশের এই বিপদের দিনে সবাই কাজ করছে এটা শুনে আমার ভাল লাগে।
করোনাকালীন সময়ে দায়িত্ব পালনের বিরুপ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভূতি রঞ্জন বলেন, করেনার সময়ে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ ও মানবতার খুব অভাব।করোনা আতঙ্কে বেশীরভাগ মানুষ দায়িত্ব কর্তব্যবোধ ভুলে গেছেন। আতঙ্কিত না হয়ে এখান থেকে সরে এসে করোনা আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ থাকা মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ করেন। উজিরপুরের যুগীরকান্দা গ্রামের একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হওয়ায় এলাকার লোকজন পরিবারটির ওপর মানুষিক, শারীরিক ও সামাজিকভাবে অত্যচার চালায়। পরবর্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের স্যম্পল আনতে গেলে ওই পরিবার কেউই অপবাদ ও অত্যাচারের ভয়ে কেউই স্যম্পল দিতে রাজি হননি। এমন কি পরিবার সিদ্বান্ত নেন তারা মারা যাবেন কিন্তু করোনা পরীক্ষা করাবেন না। সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে পরিবারটি বুঝিয়ে ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় ১৩ ঘন্টা বসে থেকে স্যম্পল আনতে হয়েছে।সমাজে এ ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সকলকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান।
এ প্রসঙ্গে উজিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শওকত আলী বলেন, প্রথম দিকে করোনা আতঙ্কে দেখা দিলে কেউই স্যম্পল আনতে রাজি হননি। তখন আমি বিভূতি রঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই ১০/১২টি স্যম্পল সংগ্রহ করেছি। পরবর্তিতে সকল ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে গত আড়াই মাসে টেকনোলজিস্ট বিভূতি রঞ্জন একাই প্রায় ২শর বেশী স্যাম্পল সংগহ করে একটানা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভূতি রঞ্জন সত্যিকারে একজন করোনা যোদ্ধা। বিয়ের দুই দিন পরে স্ত্রীকে ফেলে রেখে একটানা সেবা দিয়ে দেশের জন্য সে যে ত্যাগ করেছে সত্যিই তা প্রশংসার দাবি রাখে।
করেনায় সেবা দিচ্ছেন পরিবারের ৭ সদস্য
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টেকনোলোজিষ্ট বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ (৩৬), বড় বোন বিউটি রানী বাড়ৈ (৪৬) ঢাকা শ্যমলী টিভি হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, মেজ বোন নুপুর রানী নার্স হিসেবে তেজগা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। করোনা রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে নুপুর নিজেই আক্রান্ত হন পরে করোনাকে জয় করে সুস্থ্য হয়ে পুনরায় কাজে যোগদান করেন। নুপুরের স্বামী ডাঃ স্বপন ওঝা তেজগা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। সেজ বোন অর্চনা রানী (২৭)উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। ছোট বোন রত্না রানী ঢাকার আইটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বড় ভাইর স্ত্রী মনিকা রানী মিস্ত্রী ঢাকার তেজগা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইএনটি হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।