গৌরনদী
“করোনা” মানবতার সেবক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করার সুযোগ দিয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ যেহেতু মানবতার সেবায় নিজেদের সমর্পন করেছি, সেহেতু ভয় পেয়ে লাভ নেই। তাই বাঁচতে হয় এক সঙ্গে বাঁচবো, মরতে হয় এক সঙ্গে মরবো তবুও ভয় পেয়ে মানুষকে সেবা দেয়া থেকে সরে যাবো না। এ কথাগুলো বরিশালের এক চিকিৎসক দম্পত্তির । দুজনেই বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। উজিরপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শওকত আলী ও তার সহধর্মীনি মেডিকেল অফিসার ডাঃ নাদিরা পারভীন। এ চিকিৎসক দম্পত্তি দেশের করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে একটানা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। করোনা নমুনা সংগ্রহ ও সেবা প্রদানে যখন চিকিৎসকের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক কাজ করছিল ঠিক তখনই একের পর এক করোনা নমুনা সংগ্রহ ও নিজ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চার জন করোন রোগীকে সেবা দিয়ে মানুষের কাছে করোনা যোদ্ধা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ শওকত আলী ও স্ত্রী মেডিকেল অফিসার (পরিবার পরিকল্পনা) ডাঃ নাদিরা পারভিন।
ডাঃ শওকত আলী বলেন, বিয়ের পরে ৮ বছর নিঃসন্তান ছিলাম। আমাদের ১৫ মাসের দুগ্ধপোষ্য নাজিফা বিনতে শওকত নামে একটি সন্তান রয়েছে। আমার ও স্ত্রীর বাবা মা বৃদ্ধ হওয়ায় সনন্তাকে তাদের কাছে রাখার সুযোগ নেই। তাই বাসায় গৃহপরিচারিকার কাছে রেখেই দুজনে নিয়মিত মানুষকে সেবা দিতে কাজ করে যাচ্ছি। একদিকে সন্তান আরেক দিকে সেবা দুটি নিয়ে ভাবার পরে দেশের দুঃসময়ে আমাদের কাছে সেবাই প্রধান্য পায়। করোনা রোগীর সেবা দেয়ার নিয়ম অনুযায়ী একজন চিকিৎসক ১০দিন সেবা দেয়ার পরে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবে তারপরে ৬দিন পরিবারের সঙ্গে থাকবে । আমার নিয়ম মানার সুযোগ ছিল না। রোগীকে সুস্থ্য করতেই এ নিয়ম ভেঙ্গে একটানা ২০ দিন সেবা দিয়ে করোনা দুই শিশুকে সুস্থ্য করে তুলেছি। বর্তমান হাসপাতালে ভর্তি এক রোগী ৬দিন ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। স্ত্রীকে ছুটি নিয়ে সন্তানের পাশে থাকতে বললে সে আমাকে জানায়, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মাঠ ছাড়া যাবে না। ডাক্তার হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় মানবতার সেবায় নিজেদের সমর্পন করেছি, সেহেতু পরিনিত যাই হোক স্বীয় স্বার্থ বা ভয়ে মাঠ ছাড়া যাবে না। বাঁচতে হয় এক সঙ্গে বাঁচবো, মরতে হয় এক সঙ্গে মরবো।
স্ত্রী ডাঃ নাদিরা পারভীন বলেন, দেশের স্বাভাবিক পরিস্তিতিতে মানুষকে সেবা দেয়া একটি রুটিন কাজ বলে আমি করি। একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। “করোনা মানবতার সেবক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না”। দেশের এই সময়ে করোনা যুদ্ধের মাঠে বীরের মত মানুষের পাশে থেকে ভূমিকা রাখতে চাই।
উজিরপুর উপজেলা কমপ্লেক্সের একাধিক সূত্র জানান, বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র দুজন। করোনাকালীন সময়ে প্রশাসনিক কাজেই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ব্যাস্থ থাকার কথা কিন্তু চিকিৎসক সংকটের কারনে গত দুই মাস তাকে রোগীদের সেবা দিতে হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে সাধারন রোগীদের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে মুঠোফোনে পরামর্শে সেবা দেয়ার রেওয়াজ চালু হলেও করোনার শুরু থেকে উজিরপুরে সরাসরি সাধারন রোগীদের সেবা প্রদান উন্মুক্ত রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় বরিশালের ১০টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একমাত্র উজিরপুর ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে কোথায়ও করোনা রোগীর সেবা দেয়া হয়নি। একমাত্র উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চার জন করোনা রোগীর সেবা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে দুজন সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরছেন, একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং বর্তমানে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ শওকত আলী জানান, উজিরপুর উপজেলায় করোনা উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ্য হওয়া ৪০ জন রোগীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার মধ্যে দুই শিশু ও দুই যুবকের করোনা পজেটিভ সনাক্ত হয়। প্রথম দিকে যখন এ কাজটি করতে অনেকেই ভয় পান তখন তিনি নিজেই প্রথম দিকে ঝুঁকি নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। ১৪ এপ্রিল করেনা উপসর্গ নিয়ে ৯ বছরের শিশু রাহাত ফরাজী ও ৮মাসের শিশু নাঈমা হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিন তাদের নমুমা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠালে ১৬ এপ্রিল পরীক্ষায় করোনা পজেটিভ ধরা পরে। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করা হয়। রাহাত ফরাজী ২০দিন হাসপাতালে র্ভতি থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যান রাহাত এবং ৮দিন সুস্থ্য হয়ে ফিরে যান নাঈমা (৮মাস)। রাহাত ফরাজীর বাবা শিমুল ফরাজী (২৮) বলেন, ডাঃ শওকত স্যারে আমার ছেলে জন্য যা করেছে তা হয়তো আমি করতে পারতাম না। করোনা রোগীকে দরদ দিয়ে এভাবে সেবা দেয়া বিরল ঘটনা। ১৯ এপ্রিল উজিরপুর উপজেলার ওটরা ইউনিয়নের যুগিরকান্দা গ্রামের এক যুবক (৩৮) জ্বর, কাশী, গলাব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে আসলে তাকে ভর্তি নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো ২১ এপ্রিল তার করোনা পজেটিভ ধরা পরে। ওই যুবককে হাসপাতালে পরে তার নিজ বাড়িতে রেখে বাড়ি রেখে বাড়ি গিয়ে সেবা দেন ডাঃ শওকত আলী। ৪দিন সেবা প্রদানের পরে অবস্থা খারাপ হলে তাকে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ৩ মে করেনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসেন এক যুবক (৪২) তার নমুনা সংগ্রহ করে পাঠালে ৫ মে করোনা পজেটিভ সনাক্ত হয়। তাকে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এসব রোগীর স্বজনরা জানান, করোনা আক্রন্ত পাশে আমরা যেতে যখন ভয় পাই, তখন ভয়কে জয় করে ডাঃ শওকত আলী করোনা রোগীকে আপন মমতায় দেখ ভাল করেছে। রোগীকে সাহস দিয়েছে। সুস্থ্য করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে সেবা দিয়েছে। করোনা যুদ্ধে সে সত্যিকারের মানবতার সাহসী সেবক। উজিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ সিকদার বলেন, করোনা যুদ্ধ শুরুতে করোনা রোগীকে সেবা দেয়ার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সু-রক্ষা, আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুতসহ যথেষ্ট সামর্থ ছিল না কিন্তু সেই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ডাঃ শওকত আলী দম্পত্তি করোনা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। চিকিৎসক দম্পত্তি সত্যিই মানবতার সেবক। করোনা যুদ্ধে উপজেলা পরিষদ থেকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান অব্যহত থাকবে।