গৌরনদী
চলে গেলেন গৌরনদীর সেই অভিমানি মুক্তিযোদ্ধা
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ প্রতিহিংসার বিরোধের জের ধরে মিথ্যা অভিযোগে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের ৭১‘র রনাঙ্গনের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সাকোকাঠি গ্রামের পিতামৃত গোঞ্জর আলী খানের ছেলে ইসমাইল খানের ৬ বছর ধরে ভাতা ছিল। ভাতা বন্ধ থাকায় সমস্ত ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করানোর পরেও অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় দূর্বিষহ জীবন কাটান মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান (৬৩)। তাকে নিয়ে পত্রিকায় “ভাতা বন্ধ ছয় বছর, দূর্বিষহ জীবন” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। মৃত্যু শয্যায় অভিমানি মুক্তিযোদ্ধার অছিয়ত ছিল মৃত্যুর পরে যেন তাকে যেন তাকে রাষ্ট্রিয় মর্যদা দেয়া না হয়। জীবদ্দশায় ভাতা চালু হওয়ায় সেই অছিয়ত প্রত্যাহার করে নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পরপারে চলে গেলেই মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান।
গতকাল বৃহস্পতিবার মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানকে এক নজর দেখার জন্য গ্রামবাসি ও সহযোদ্ধাদের ভিড়। চলছে স্বজনদের আহাজারি। কাঁদতে কাঁদতে বার বার মূর্ছা যান স্ত্রী রেনু বেগম (৫২)। এ সময় তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, অভাব- অনাটনে দীর্ঘ দিন বিনা চিকিৎসায় দূর্বিষহ জীবন কাটলেও আমার স্বামী শেষ পর্যন্ত ভাতা চালু দেখে শান্তিতে মরতে পারছেন। মরার আগে তার কোন কষ্ট ছিল না। আদালতের ন্যায় বিচারের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। ষরযন্ত্রকারীরা পরাজিত হয়েছে। জীবদ্দশায় আমার স্বামী রাষ্ট্রিয় মর্যদা না নেওয়ার অভিমানের কথা প্রত্যহার করে নিয়েছিল।
একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারের সদস্যরা জানান, একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পেয়ে পরিবার নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের পরিবার । এ সময় একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, সরিকল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল খান (৬৭) ২০১৩ সালে ইসমাইল খানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, ইসমাইল খান মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু যুদ্ধাহত নন। ২০১৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় বিষয়টি তদন্তের জন্য বরিশাল জেলা প্রশাসকে নির্দেশ দেন। তদন্তকালে মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ও তার সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধারা জেলা প্রশাসকের কাছে মিথ্যা স্বাক্ষাী দিলে ইসমাইল খান মুক্তিযোদ্ধা নন জেলা প্রশাসকের তদন্ত প্রতিবেদনের পেক্ষিতে ওই বছর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের ভাতা বন্ধ করে দেন মন্ত্রনালয়। পরবর্তিতে ইসমাইল খান আদালতে মামলা মামলা নিন্ম আদালত ভাতা বন্ধের পক্ষে রায় প্রদান করেন। ইসমাইল খান বিষয়টি উচ্চ অদালতে আপীল করেন।
স্ত্রী রেনু বেগম বলেন, মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকায় কোন রকম সংসার চলছিল । ২০১৩ সালে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভাতা বন্ধের দুশ্চিন্তায় মুক্তিযোদ্ধা স্বামী লিভার ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারিভাবে পাওয়া জমি ও ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ চালান। শেষ দিকে অর্থের অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে দূর্বিসহ জীবন কাটে। এ সময় আমার স্বামী অভিমান করে বলেছিল, বেঁচে থাকতে অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছি, মৃত্যুর পরে যেন আমাকে রাষ্ট্রিয় মর্যদা দেয়া না হয়। কিন্তু স্বামী জীবিত অবস্থায় গত গত ৭ জানুয়ারি উচ্চ আদালত ইসমাইল খানের পক্ষে যুদ্ধাহত মক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা প্রদানের রায় প্রদান করলে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় ভাতা চালু করেন। ভাতা চালু করতে মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে গত ৭ ফ্রেবুয়ারি আমি তিন মাসের ভাতা হিসেবে ৯০ হাজার ৩ শত ৩০ টাকা পেয়েছি। ওই টাকায় তার (স্বামী) চিকিৎসা হয়েছে। বিগত দিনের বকেয়া টাকা পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। ভাতা চালু দেখে গেছেন এবং শেষ মুহুর্তে ওই টাকায় চিকিৎসা হয়েছে স্বামী ইসমাইল খানের। তিনি শান্তিতে মরতে পারছেন। তার অভিমান প্রত্যাহার গেছেন। মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রিয় মর্যদা গ্রহন করতে আমাদের নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
গ্রামের নার্গিস আক্তার বলেন, মুক্তিযোদ্ধার বসত ঘরসহ শেষ সম্বল ৬ শতাংশ ভিটে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকায় আমি কিনে নিয়ে মানবিক কারনে অসুস্থ্য মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সেখানে থাকতে দিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু হয়েছে বকেয়া পেলে এবং আমার টাকা ফেরত দিলে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে আমি ভিটেমাটি ফেরত দিবো। এ প্রসঙ্গে অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন খান বলেন, আদালতের নির্দেশ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের ভাতা চালু হয়েছে, এ রায় মেনে নিয়েছি। সে মারা গেছে তার সঙ্গে আমার আর কোন শত্রæতা নেই।
এ প্রসঙ্গে গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত জাহান বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে মন্ত্রনালয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের ভাতা চালু করেছে এবং তিনি বেঁচে থাকতেই তিন মাসের ভাতা গ্রহন করেছেন। পর্যায় ক্রমে বকেয়া ভাতা প্রদান করা হবে। মুক্তিযোদ্ধার পরিবার আমাকে জানিয়েছেন মৃত্যুর আগে ভাতা চালু হওয়ায় ইসমাইল খান তার অছিয়ত প্রত্যাহার করে নেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাষ্ট্রিয় মর্যদায তাকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।