গৌরনদী
মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক
জহুরুল ইসলাম জহির, উজিরপুর থেকে ফিরে
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বুক চিরে বহমান বরিশালের সন্ধ্যা নদী। নদীর তীরে উজিরপুরের কমলপুর এলাকায় কমলাপুর-দাসেরহাট খেয়াঘাট। এ খেয়াঘাট দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু যাতায়াত করে থাকে। এ খেয়া ঘাটে প্রতিদিন যাতায়াতকারী হাজার হাজার মানুষকে জড়ো করে ৭১‘র স্মৃতি চারন ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান উপজেলার বানকাঠী গ্রামের মৃত এন্তজ উদ্দিন হাওলারের ছেলে ৭১‘র রনাঙ্গনের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু আব্দুল খালেক হাওলাদার (৯৬)। সাধারন মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো ও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই গত ১০/১২ বছর ধরে প্রতিনিয়ত এ কাজটি করে থাকেন আব্দুল খালেক হাওলাদার ।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে বরিশালের প্রত্যন্ত পল্লি উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের বৈরকাঠী গ্রামে রওয়ানা হয়ে সকাল ১০ টায় সন্ধ্যা নদীর তীরে উজিরপুরের কমলাপুর খেয়াঘাটে পৌছতেই খেয়াটি ছেড়ে যান। পরবর্তি খেয়ার জন্য অপেক্ষা। এ সময় সন্ধ্যা নদীর উত্তর পাশে নদীর তীরে দেখা যায়, অশিতপর এক পঙ্গু বৃদ্ধ মাটিতে বসে আছে। গলায় তার একটি খুতি ঝোলানে। যে কেউর দেখলে মনে হবে কোন হতদরিদ্র খেয়াঘাটে ভিক্ষার জন্য গলায় খুতি ঝুলিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষন পরই তিনি শ্রোতাবিহীন একাকি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে শুরু করেন। মুহুর্তেই সেখানে শ্রোতা হিসেবে একে একে প্রায় অর্ধ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু জড়ো হন। খেয়ার জন্য অপেক্ষমান সকলেই মনোযোগ সহকারে পঙ্গু বৃদ্ধার কথা শোনছেন। ১০/১৫ মিনিট পর খেয়া ছাড়ার সময় হলে সকলেই হুরুহুর করে খেয়া উঠে যান। পেশাগত কাজ শেষ করে দুপুর দেড়টায় ফেরার পথে ওই খেয়া ঘাটে একই দৃশ্য চোখে পড়ল। এ সময় বিষয়টি জানার কৌতুহল থেকে খেয়াঘাটের চায়ের দোকানে বসে চা পান করে বিষয়টি জানা ও বোঝার চেষ্টা থেকে চায়ের দোকানীর সঙ্গে কথা বলেই জানা গেল চাঞ্চল্যকর তথ্য।
চায়ের দোকানদার কমলাপুর গ্রামের আব্দুল হক (৫৬) জানান, উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া বানকাঠী গ্রামে মৃত এন্তজ উদ্দিন হাওলারের ছেলে আব্দুল খালেক হাওলাদার (৯৬) একজন যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। দেখলে ভিক্ষুক মনে হলেও তিনি কোন ভিক্ষুক নন। খালেক প্রতিদিন সকালে একাই পাছায় ভর করে এখানে এসে বসেন এবং সন্ধ্যা অবদি এখানেই বসেই খেয়া ঘাটে ক্ষনিকের জন্য অপেক্ষমান মানুষের কাছে তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও করেন মুক্তিযদ্ধের স্মৃুতিচারন। নবীন ও তরুনদের কাছে ৭১‘র পাক হানাদারদের পৈশাচিক বর্বরতা তুলে ধরেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে তার হৃদ্রতার গল্প বলে যান। চা দোকানী আব্দুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধা খালেক খানজাহান আলী ভক্ত। যদি কোন পথচারী তাকে ভিক্ষা হিসেবে কোন অর্থ দেন তা তিনি নেননা। যদি কেহ খান জাহান আলীর বার্ষিক ওরস কিংবা মাজারের জন্য অর্থ দেন তা নেন এবং গলায় ঝোলানো খুতিতে জমা করে প্রতিমাসে বাগেরহাট গিয়ে তা মাজার কর্তৃপক্ষের কাছে জমাকৃত টাকা পৌছে দেন। এভাবে গত ১০/১২ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রচার করছেন খালেক।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক হাওলাদার (৯৬) জানান, ৭০ দশকে তিনি ঢাকায় থাকতেন। পরবর্তিতে বরিশালে ফিরে এসে আনসার সদস্য হিসেবে যোগদান করে বরিশালের আনসার ব্যারাকে বসবাস করতেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাসনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় উদ্বুদ্ধ হন। দেশে গন্ডগোল শুরু হলে গ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। দেশে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে সেক্টর কমান্ডার উজিরপুরের কৃতি সন্তান মেজর এম,এ জলিলের মাধ্য্যমে ৬০ সঙ্গী নিয়ে প্রশিক্ষনের জন্য ভারতে যান। সেখানে বিহারে তারা প্রশিক্ষন শেষ করে ওই বছর আগষ্ট মাসে খুলনা বর্ডার দিয়ে দেশে ঢোকার পরে মেজর জলিলের নির্দেশে খুলনার গোল্লাবাড়ি, বড়কুলিয়া, সাতক্ষিরা, যশোর, কালীগঞ্জ শ্যামনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তযোদ্ধা আব্দুল খালেক হাওলাদার বলেন, ৭১‘র সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে গোল্লাবাড়ি পাক হানাদার ক্যাম্প আক্রমনের পরিকল্পনা করি। সিদ্বান্ত মোতাবেক আমরা হানাদার ক্যাম্পের চারিদিক থেকে গেরিলা হামলা চালাই। কয়েক ঘন্টা গোলাগুলির পরে পাক হানাদার ক্যাম্প থেকে পাল্টা জবাব আসা বন্ধ হয়ে যায়। পাক সেনা শেষ হয়েছে ভেবে আমি উঠে দাড়াতেই গুলি এসে আমার আমার দুই পায়ে ও হাতে লেগে আমি আহত হই। সহযোদ্ধারা আমাকে নিয়ে চিকিৎসা দেন। পুরোপুরি সুস্থ্য না হলে দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধু অমাকে সিংগাপুরে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ্য করে তোলেন। গত ৪৮ বছর যাবত হাত পা বিহীন পঙ্গু জীবন নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। পঙ্গুত্ব নিয়ে আমার কোন কষ্ট নেই । কষ্ট হয় যখন দেখি রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা নিয়ে রাজাকাররা সম্মানিত হন, কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি মুক্তিযদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতি চারন করে তিনি বলেন, ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে আমার কোন পাশ প্রয়োজন হত না। বঙ্গবন্ধু বাড়ির সকলকে বলে দিয়েছিল খালেকের জন্য এ দরজা উন্মুক্ত। ৭৫‘র আগষ্টের শোকাবহ ঘটনার কথা উল্লেখ করে খালেক বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসির মধ্য দিয়ে জাতী কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এটাই আমার পরম পাওয়া। থাকার জন্য সরকার ১০ লাখ টাকা ব্যায়ে ঘর করে দিছে তাতে বসবাস করছি। ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিছি, মাসে মাসে ভাতা পাই। খেয়ে দেয়ে ভালই শান্তিতে আছি। যে কয় দিন বেঁেচ আছি এখন শুধু একটাই কাজ তা হচ্ছে সাধারন মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো ও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। খেয়া ঘাটে বসে এ কাজটিই করে যাচ্ছি। বর্তমানে সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটাই সমস্যা স্ত্রী নেই। বৃদ্ধ বয়সে আমার সেবা করার জন্য একজন বিবি চাই।
উজিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোঃ হারুন অর রশিদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক একজন প্রকৃত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধ, অনেক মন্ত্রী এমপিসহ বর বড় মানের নেতাদের স্নেহধন্য ছিলেন। তাকে সব সময় আমরা সব ধরনের সাহায্য সহযোগীতা দিয়ে থাকি।