গৌরনদী
কষ্টি পাথরের মূর্তি আত্মসাতের বিরোধে নান্টু চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ড? ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রত্যহারে ৬ আসামির আদালতে আবেদন
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি আলোচিত বিশ্বজিৎ হালদার ওরফে নান্টু হত্যা মামলার ৬ আসামি গত ৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি প্রত্যাহারে বরিশাল চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেড আদালতে আবেদন করেছেন। আদালতের বিচারক মোঃ এনায়েত উল্লাহ্ আসামীদের দেওয়া আবেদনপত্রগুলো আমলে নিয়ে মামলার নথিতে অর্ন্তভূক্ত করার নির্দেশ দেন।
আদালতে জবানবন্দি প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন এবং একই সথে নতুন জবানবন্দি দেওয়া আসামিরা হলেন, জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন শাহ ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য কাওসার সেরনিয়াবাত, দীপক বালা, সাকিল ইসলাম রাব্বি, হাদিরুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস। আবেদন করা আসামিরা সকলেই জেল হাজতে রয়েছে।
আদালতে দেওয়া আবেদনে আসামিরা দাবি করেন, পুলিশ তাদের অমানসিক নির্যাত ও ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিখে পুলিশ স্বাক্ষর নেন এবং আদালতে স্বীকার না করলে পুনরায় রিমাণ্ডে এনে ক্রসফায়ার দেওয়ার ভয় দেখায়। তাছাড়া দুই আসামি জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন শাহ ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য কাওসার সেরনিয়াবাত আবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তারা দুজনেই আদালতে দাবি করেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি আলোচিত বিশ্বজিৎ হালদারের সঙ্গে তাদের প্রকাশ্যে বিরাধ ছিল। কিন্তু উজিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উজিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মো. হাফিজুর রহমান ইকবালের সঙ্গে মূল্যবান কষ্টি পাথরের একটি মূর্তি বিক্রির টাকা ও আরেককটি মূর্তি আত্মসাধ নিয়ে গোপন বিরোধ ছিল। ওই গোপন বিরোধে উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদারকে হত্যা করিয়ে প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে আমাদের ওপর দায় চাপিয়ে হয়রানী করেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান পুলিশকে প্রভাবিত করে তাদের মামলায় আসামি করেছে।
আদালতে দেওয়া জাবনবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনে আসামী মামুন শাহ উল্লেখ করেন, ইউচি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার খুন হওয়ার কিছুদিন আগে বিশ্বজিৎ হালদার কুলেরবাজারের বাসিন্দা লাবাই বাড়ৈ’র মাধ্যমে কষ্টি পাথরের দুটি মূর্তি হাফিজুর রহমানের হাতে তুলে দেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান একটি মূর্তি বিক্রির টাকা ও আরেকটি মূর্তি আত্মসাত করেন। পরবর্তি হাফিজুর রহমান বিশ্বজিৎ হালদারের কাছ থেকে মূর্তি নেওয়ার কথা অস্বীকার করলে ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের গোপন বিরোধ শুরু হয় এবং দীঘদিন ধরে গোপন বিরোধ চলে আসছিল। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উজিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক মো. হেলাল উদ্দিন আমাকে হাত, পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন করে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারউক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেন। একই কথা উল্লেখ করেন আদালতে দেওয়া জাবনবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন আরেক আসামি জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য আসামী কাওসার সেরনিয়াবাত।
আসামী দীপক বালা তার লিখিত জবানবন্দীতে বলেন, চেয়ারম্যান নান্টু হত্যার ঘটনায় আমি কিছুই জানিনা। উজিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের প্ররোচনায় উজিরপুর মডেল থানার ওসি শিশির কুমার পাল আটক করে বরিশাল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে ইকবাল চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন শাহ ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য কাওসার সেরনিয়াবাত, দীপক বালা, সাকিল ইসলাম রাব্বি, হাদিরুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুসের নাম বলতে বলেন। এ সময় উপজেলা চেয়ারম্যা আমাকে বলেন, উল্লেখিত আসামিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত এইমর্মে লেখা কাগজে পুলিশ স্বক্ষর চাইলে স্বাক্ষর করবি। তোর কোন ভয় নাই। তোর জন্য যা কিছু করা দরকার আমি দেখবো। এ কথা বলে ইকবাল আমাকে নগদ ৩ হাজার টাকা এবং একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জী কিনে দেন। পরে পুলিশ আমার কাছ থেকে কাগজে স্বাক্ষর নেন এবং আদালতে শেখানো কথা বলতে বলেন।
আসামি সাকিল ইসলাম আবেদনে উল্লেখ করেছেন, হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উজিরপুর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) হেলাল উদ্দিন একদল নিয়ে গত ৪ নভেম্বর ঢাকাস্থ ছাত্রলীগের কার্যালয় থেকে আমাদের দুজনকে আটক করে। এ সময় পুলিশ আমাদের হাতে পিস্তল, ইয়াবা ও সাদা লবন জাতীয় প্যাকেট দিয়ে ভিডিও করে। এ সময় অফিসের সিসি ক্যামেরা, মনিটর, প্রাইভেটকারের চাবি, নগদ অর্থ, ট্যাব ও মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিয়ে যায় পুলিশ। তার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে ও চোখ মুখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং হাতিরঝিলে নিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দেয়। পরে বরিশাল জেলা ডিবি অফিসে নিয়ে একটি রুমে আটকে তাকে নগ্ন করে ইলেকট্রিক শর্টসহ নির্মম শারিরিক নির্যাতন চালিয়ে আদালতে স্বীকারউক্তি দেয়ায়।
উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিশির কুমার পাল বলেন, বক্তব্য প্রত্যহারের আবেদন করা আসামির অইনগত অধিকার। উজিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম চলমান। ফরেনসিক ও ব্যালেষ্টিক রিপোর্ট হাতে পেলে চার্জশীট প্রদান করা হবে। আসামীদের নির্যাতনের, মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ সঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে আদালত পরিদর্শক (ওসি) মো. ফিরোজ কবির বলেন, আদালতের বিচারক বিষয়টি নথিভূক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু কোন শুনানির দিন ধার্য্য করেননি।
উল্লেখ্য, গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের কারফা বাজারে নিজ কাপড়ের দোকানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু। এ ঘটনায় পরের দিন নান্টুর বাবা শুখলাল হালদার বাদি হয়ে ৩২ জনের নাম উল্লেখ ও ৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে উজিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন । মামলার এজাহারভুক্ত কমপক্ষে ২০ আসামী বর্তমানে বরিশাল জেল হাজতে রয়েছে। এছাড়া এ হত্যাকান্ডের ১৩ নভেম্বর রাতে মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম নামে এক যুবক পুলিশের সাথে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং পুলিশের দাবী ছিলো নিহত যুবক ইউপি চেয়ারম্যান নান্টুকে গুলি করেছে ।