গৌরনদী
গৌরনদীতে ব্যবসায়ী পরিবারকে বসতঘর থেকে বের দিয়ে দখল নিলেন দুই দাদন ব্যবসায়ী
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/ ঋনের টাকা পরিশোধ করত না পারায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলার টরকী এলাকায় দুই সুদী কারবারি ব্যবসায়ীকে বসত ভিটা থেকে বের করে দিয়ে ভিটেহারা করে ঘরটি দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভিটেমাটি হারিয়ে পরিবারটি অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বসত ভিটে দখল নেওয়ার সময় শত শত মানুষ দাড়িয়ে দেখলে প্রভাবশালী সুদ ব্যবায়ীদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পাননি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বন্দরের সাধারন ব্যবসায়ী। এ ছাড়া অর্ধশত সুদি কারবারিদের খপ্পরে পড়ে ৫শত লোক এলাকা ছেড়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন, বন্দরের ব্যবসায়ী ও ভূক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছ, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার টরকীর গ্রামের মৃত কামাল উদ্দিনের ছেলে মো. নান্নু খান (৪০) ও সুন্দরদী গ্রামের মোসলেম হাওলাদারের ছেলে মাইনুল হাওলাদার দীর্ঘদিন ধরে দাদন ব্যবসা করে আসছেন। প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর এই দুই দাদন ব্যবসায়ী অভাবীদের অসুস্থ্যতা, মেয়ের বিয়ে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়, দূর্যোগসহ বিভিন্ন দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাদা স্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে চড়া সুদে ঋৃন দিচ্ছেন এবং পরবর্তিতে তাদের জমাজমি ভিটেমাটি কেড়ে নিচ্ছেন বলে ভূক্তভোগীরা জানান। এছাড়া সমিতি ভিত্তিক ছোট ও মাঝারি অর্ধশত দাদন ব্যবসায়ী রয়েছেন। দাদন ব্যবসায়ীদের নির্যাতনে এক ব্যক্তি আত্মহত্যাসহ প্রায় ৫ শতাধিক লোক এলাকা ছেড়েছে। দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে বেশীরভাগ মানুষ।
টরকী বন্দরের ব্যবসায়ী ও সুন্দরদী গ্রামের মৃত জালাল উদ্দিন মাঝির ছেলে মো. আলী মাঝি (৫৩) জানান, তিনি টরকী বন্দরে প্রায় ৪০ বছর ধরে কাপরের ব্যবসা করে আসছেন। ব্যবসা করে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে ভালভাবেই দিনকাল চলছিল। গত ১০ বছর অগে হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়লে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় ব্যবসার মূলধন প্রায় শেষ হয়ে যায়। ব্যবসা পরিচালনা করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এ সময় দাদন ব্যবসায়ী নান্নু খান তাকে ব্যবসা চালিয়ে রাখতে ১১ লক্ষ টাকা ঋৃন দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে তাকে প্রতিমাসে ৩১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিছুদন পর আরেক সুদী ব্যবসায়ী মাইনুল হাওলাদার একইভাবে ৩ লক্ষ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন। তাকে মাসে ১২ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। শর্ত মেনে দুই সুদী কারবাবারীদের কাছ থেকে ১৪ লক্ষ টাকা গ্রহন করে কোন রকম ব্যবসা টিকিয়ে রাখা হয়। গত দশ বছরে নান্নু খানকে সুদ বাবদ ৪৫ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা ও মাইনুল হাওলাদারকে ৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
আলী মাঝি অভিযোগ করে বলেন, কিছু দিন যাবত দুই ব্যবসায়ী মূল টাকার জন্য আমাকে চাপ প্রয়োগ করেন। বর্তমানে ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারনে মূল টাকা দিতে না পারলেও সুদের টাকা আমি নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি। গত সোমবার সকালে সুদী ব্যবসায়ী নান্নু খান ও মাইনুল হাওলাদার লোকজন নিয়ে আমার বাড়িতে এসে দুটি সাদা ষ্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে বসত ঘর থেকে আমাকে, আমার স্ত্রী ফাহমিদা ইয়াসমিন ও স্কুল পড়–য়া কন্যা ত্রীনা আক্তারকে টেনে হেচরে ঘর থেকে বের দিয়ে বসত ঘর দখল নিয়ে তালাবদ্ধ করে দেন। আমার মেয়ে এবারে এসএসসি পরীক্ষার্থী তার বাছনিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে ঘর থেকে বের করে দিলে তার পড়াশোনার ক্ষতি হবে জানিয়ে এসময় নির্দয় না হওয়ার জন্য বহু অনুনয় বিনয় করলেও সুদী কারবারীদের মন গলাতে পারিনি। বর্তমানে আমি এক আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। বিষয়টি শত শত মানুষ দেখলে কেউই সুদী কারবারিদের ভয়ে কথা বলতে সাহস পাননি। পরে স্থানীয় প্রশানকে অবহিত করা হয়। আলী মাঝির স্ত্রী ফাহমিদা ইয়াসমিন বলেন, আমি নান্নুর হাত পা ধরে মেয়ের পরীক্ষার জন্য ৭টি দিন সময় চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে কোন সময় দেয়নি। এক কাপরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ঘর দখল নিয়েছে।
একইভাবে অভিযোগ করে টরকী বন্দরের আরেক ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, এক সময় আমি টরকী বন্দরের বড় ব্যবসায়ী ছিলাম। মামলা সংক্রান্ত এক বিপদে পরে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিছু টাকা নেই। মূল টাকার কয়েকগুন বেশী শোধ করার পরেও পাওনা টাকার জন্য দাদন ব্যবসায়ীরা আমার কাছ থেকে সাদা ষ্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে আমার দোকান ঘর দখল নিয়ে আমাকে টরকী থেকে বিতারিত করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তর বেজগাতি গ্রামের দরিদ্র এক কৃষক বলেন, অসুস্থ্য স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য দাদন ব্যবসায়ী আবু হানিফের কাছ থেকে শতকরা ৩০টাকা সুদে দেড় হাজার টাকা ঋৃন নেই। পরে ৫হাজার টাকা শোধ করার পরেও সুদীমহাজন আবু হানিফের দাবিকৃত তিন হাজার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ১০/১২জন সন্ত্রাসী নিয়ে হামলা করে এক পর্যায়ে পাওনা টাকার দায়ে ঘরের দিন খুলে নেন। একই অভিযোগ করেন সাত্তার হাওলাদার, কবির সিকদার, আবদুল হাওলাদারসহ অনেকেই। তারা জানান, দাদন ব্যবসায়ীর ভয়ে টরকী, বেজগাতি, বাউরগাতি, তারাকুপি বার্থী এলাকার প্রায় ৫শতাধিক লোক এলাকা ছেড়েছে।
অভিযোগের ব্যপারে মো. নান্নু খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সুদ নয়, দোকান বন্ধক রেখে ১১ লক্ষ টাকা নিয়েছিল ওই ভিটির ভাড়া বাবত আমি মাসিক টাকা নিয়েছি। পরিবার পরিজনসহ বসত ঘর থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়, সে স্বেচ্ছায় নিজেই ঘর ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে দেনা পরিশোধ করতে ঘরটি বিশ লক্ষ টাকায় বিক্রি করেছে। সাদা ষ্টাম্পে স্বাক্ষর ও ঘর দখলে নিয়ে তালাবদ্ধ করে দেওয়ার কথা স্বীকার মাইনুল হাওলাদার বলেন, আলী মাঝির কাছে পাওনাদারদের টাকা আমরা পরিশোধ করেছি বিধায় ওই টাকার জন্য আমরা তার বাড়ি বন্ধক নিয়েছি। টাকা শোধ করলে ফেরত দেয়া হবে।
টরকী বন্দরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও উপজেলা আ.লীগের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক কামরুল ইসলাম দিলিপ মাঝি অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ১১ লক্ষ টাকায় ৪৫ লক্ষ টাকা পরিশোধ করার পরেও একজন ব্যসায়ীকে স্বপরিবারে বাসা থেকে বের করে দিয়ে ষ্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে দখল নেওয়া নির্মম ও অমানবিক। বিষয়টিতে মানবিক পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান। টরকী বন্দর বনিক সমিতির সাধারন সম্পাদক মো. বুলবুল দেওয়ান বলেন, স্ত্রী সন্তানসহ একটি ব্যবসায়ী পরিবারকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বসত ঘর দখল করে নেওয়া চরম নিন্দনীয়। এর বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। গৌরনদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে পরিদর্শক (ওসিতদন্ত) এস, এম, আফজাল হোসেন বলেন, এ বিষয়ে কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ করে নাই। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।