গৌরনদী
উজিরপুরে ইউপি চেয়ারম্যান হত্যার ঘটনায় সাংসদের একান্তসচিবসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার-৫
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম/
ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ হালদার(৪৫)কে গুলি করে হত্যা করে দূবৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা সুখ রঞ্জন হালদার বাদি হয়ে শুক্রবার রাতে উজিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দাযের করেছে। মামলায় বরিশাল-১ আসনের সাংসদ তালুকদার মো. ইউনুসের একান্ত সচিবসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে জল্লা পুলিশ ক্যাম্পের দুই উপ-পরিদর্শক (এসআই)কে প্রত্যহার করে বরিশাল পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। এদিকে চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার হত্যার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে গতকাল উপজেলা সদরে ও নিজ এলাকা জল্লায় বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যহত করেছে আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মি ও স্বজনরা।
উজিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) মো. হেলাল উদ্দিন জানান, উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ হালদার(৪৫)কে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শুক্রবার রাতে নিহতের বাবা সুখ রঞ্জন হালদার বাদি হয়ে ৩২ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। মামলার উল্লেখ্যযোগ আসামিরা হলেন, বরিশাল-১ আসনের সাংসদ আইনজীবি তালুকদার মো. ইউনুসের একান্তসচিক গৌরনদী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে সাঈদ, জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও জল্লা ইউনিয়ন স্বেচ্ছসেবকলীগের সভাপতি তাইজুল ইসলাম, জল্লা ইউনিয়ন আ.লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক মো. নান্নু সিকদার, আ.লীগ সদস্য লুৎফর রহমান, সমরেশ বাড়ৈ, জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মো. মামুন শাহ, প্রভাবশালী সদস্য মো. রাব্বি। তিনি আরো বলেন, হত্যাকাÐে জড়িত থাকার অভিযোগে এজাহারভূক্ত আসামি জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও জল্লা ইউনিয়ন স্বেচ্ছসেবকলীগের সভাপতি তাইজুল ইসলাম, আইয়ুব আলী ফরাজী, হরষিত রায়, সাইদুল ইসলাম ও মান্নান হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে গতকাল রোববার আদালতের মাধ্যমে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যন অসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গতকাল রোববার বিশ্বজিৎ হত্যার দাবিতে উত্তাল উজিরপুর উপজেলা সদর ও জল্লা ইউনিয়ন। সকাল ১০ উপজেলা আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপি ব্যাপী মানববন্ধনে দলীয় নেতাকর্মিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নেন। উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. জামাল হোসেন মাষ্টারের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বরিশাল-১ আসনের সাংসদ আইনজীবি তালুকদার মো. ইউনুস, উজিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান, গৌরনদী উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী, উজিরপুর উপজেলা আ.লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল মজিদ সিকদার, উজিরপুর পৌর মেয়র ও যুবলীগ সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিনসহ উজিরপুর উপজেলার ৮ ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি সম্পাদক। বক্তারা অনতিবিলম্বে খুনিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারসহ দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এেিদক নিহত চেয়ারম্যানের নিজ বাড়ি জল্লা ইউনিয়ননের কারফা বাজারে গতকাল দিনভর বিক্ষোভ সমাবেশে করেছে এলাকার বিক্ষুব্ধ সহ¯্রাধিক মানুষ ও স্বজনরা। তাদের দাবি খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষনা দেন।
দুপুর ১২টায় কারফা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কারফা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বাজারের দোকান পাট বন্ধ রয়েছে। বাজারের সড়ক দখল করে অবরোধ করছে কয়েক হাজার মানুষ। তারা খুনিদের ফাঁসি চেয়ে মুর্হু মুর্হু শ্লোগান দিচ্ছে। বাজারের মধ্যে একটা ভয়াংকর আতঙ্ক বিরাজ করেছে। নাম প্রকাশ না করার মর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, শনিবার কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুট হওয়ার পরে দোকান পাট খুলতে ভয় পাচ্ছে তারা। নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে স্বজনদের ভীড়। তাদের কান্নায় আকাশ বাতাশ ভাড়ি হয়ে উঠে। বিলাব করে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যান নিহত চেয়ারম্যানের স্ত্রী দেবী রানী হালদার, বোন সন্ধ্যা রানী, বিউটি রানী ও কনক রানী। এসময় উপস্থিত স্থাণীয় কয়েকজন নারী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মোগো বিপদে আপদে চেয়ারম্যান ঝাপাইয়া পড়ত, কষ্ট বুঝতে দিত না এ্যাহন কে মোগো দেখবে।
বরিশাল পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের একটি সূত্র জানান, দায়িত্বে অবহলো ও গাফলতির কারনে জল্লা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ উপ-পরিদর্মক (এসআই) মো. মিজানুর রহমান ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) বি,এম ইউসুফ হোসেনকে শনিবার প্রত্যাহার করে বরিশাল পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। বরিশাল-১ আসনের সাংসদ তালুকদার মো. ইউনুসে একান্ত সচিব মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে সাঈদ বলেন, অভিযোগের সঙ্গে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান আমাকে জড়িয়ে মিথ্যাচার করেছে। হাফিজুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে উচ্চবিলাশী রাজনৈতিক লালসা চরিতার্থ করতে এবং জনপিয় সাংসদকে বিতর্কিত করতে ঘটনার সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে বিবৃতি দিচ্ছে। আ.লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় এ ধরনের বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রতি অনুরোধ জানান।
বিক্ষুব্ধদের তাÐবে নিঃস্ব ১০টি পরিবার
বিশ্বজিৎ হালদার হত্যার প্রতিবাদে গত শনিবার কারফা বাজারে বিক্ষোভ করেছে কয়েক হাজার মানুষ। এসময় কতিপয় বিক্ষুব্ধ যুবক বাজারের চারটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে হামলা করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। শনিবার সকাল ১১টার দিকে কারফা বাজারের দক্ষিন দিকে মালেশিয়া প্রবাসী খোকন সরদারের তিনতলা বাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা ভাংচুর ও লুটপাটের এক পর্যায়ে ডিজেল ও পেট্রাল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই বাড়িতে ৬টি ফ্লাটে ভাড়া থাকতেন ৬টি পরিবার। হামলার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা বাসাবাড়ি ফেলে এক কাপরে সন্তান ও সদস্যদের নিয়ে প্রান রক্ষায় পালিয়ে যান। সকাল রাত ১০ টা পর্যন্ত তাÐব চালানো হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মি ও মিডিয়া কর্মিরা ঘটনাস্থলে যেতে চাইলে বিক্ষুব্ধ হামলাকারীরা সেখানে কাউকে যেতে দেয়নি। সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত থেমে থেমে প্রেট্রোল ও টায়ার জ্বালিয়ে তিনতলা ভবনের ৬টি ফ্লাটে লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ সময় কারফা বাজারে শতাধিক পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছিল। গতকাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে ক্ষতিগ্রস্থ ভবনটিতে গিয়ে দেখা গেছে আগুনে পোড়ার কালো কালো দাগ। প্রতিটি ফ্লাটের দরজা জানালা পোড়া। বাসার ভেতরে পড়ে মেঝতে পড়ে আছে পোড়া আসবাবপত্র ও জামাকাপর পোড়া পোড়া ছাই।
ভবনের তিনতলার ভাড়াটে ছিল উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফামাসিষ্ট অর্চনা রানী দাস ও স্বামী ধামুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রনজিৎ দাস দম্পত্তি। হামলাকারীদের তাÐবের বর্ননা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন অর্চনা রানী দাস। অচর্না রানী বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে দেড় বছর। আমাদের ১৭ মাসের একটি শিশু সন্তান রয়েছে। সন্ত্রাসীরা বাসায় ঢুকেই ভাঙচুর শুরু করে আলমিরা ভেঙ্গে আমার বিয়ের ৫লক্ষ টাকার গহনা নগত ৪৪হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে প্রান রক্ষায় এক কাপরে সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে যাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভবনের ভাড়াটে আরো দুটি পরিবারের সদস্যরা ভাÐবের বর্ননা দিয়ে অভিযোগ করে বলেন, আমারা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা শুধু প্রানটা রক্ষা করতে পেরেছি। এ ছাড়া আমাদের কিছুই নাই। ভবনের মালিকের স্ত্রী প্রবাসী খোকন সরদারের স্ত্রী ঝুমুর আক্তার গতকাল রোববার দুপুরে বাড়িটি দেখে এসে এ প্রতিনিধিকে জানান, সম্পূর্ন তিনতলা ভবনটি পুরে ভস্মীভূত করেছে। তিনি বলেন, কি অপরাধ ছিল আমাদের, আমরা তো রাজনীতি করি না। আমরাও তো হত্যার বিচার চাই। খোকনের বৃদ্ধা মা চন্দ্রাবান বানু (৬৫) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পরে ৫ সন্তানকে নিয়ে না খেয়ে দিনমজুর খেটে সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। বিদেশে থেকে গায়ের রক্ত পানি করে ১কোটি ৩০ লক্ষ টাকা খরচ করে গত বছর বাড়িটি করেছিলাম। সন্ত্রাসীরা পুড়িয়ে দিয়ে আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। প্রবাসীর শ্বশুর সেকেন্দার আলী মৃধা (৬৫) বলেন, সন্ত্রাসীরা জামাতার ছোট ভাই সোহাগ সরদারের রড সিমেন্টের দোকানে হামলা করে নগত টাকাসহ দশ লক্ষা টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে উজিরপুর ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশনের ইনচার্জ মো. ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, আগুনের খবর পেয়ে আমরা সকাল সাড়ে ১১টায় কারফা বাজারে পৌছি কিন্ত আমাদের আগুন নেভাতে যেতে দেয়া হয়নি। রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে আসি তখনও আগুন জ্বলছিল। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে দুই এসআইকে প্রত্যহারের সত্যতা স্বীকার করে বরিশালের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, খুনিদের সনাক্ত করে বিচার নিশ্চিত করতে পুলিশ কাজ করছে। ভবন পুড়িয়ে দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, পরিস্থিতির কারনে ভবনটি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এতে হয়তো কিছুটা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।