গৌরনদী
জীবন যুদ্ধে জয়ী গৌরনদীর শ্রেষ্ঠ পাঁচ নারীর সাফল্য গাঁথা সংগ্রামী জীবন সমাজের দৃষ্ঠান্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক, গৌরনদী২৪ ডটকম ঃ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার অসহায় হতদরিদ্র পাঁচ নারী জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, কঠোর পরিশ্রম ও দারিদ্ররতার সঙ্গে যুদ্ধে করে সমাজে আজ তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থনৈতিক সাফল্য, শিক্ষা ও চাকুরী সাফল্য, সফল জননী, নির্যাতন ও বিভীষিকা মুছে এগিয়ে যাওয়ার সাফল্য ও সমাজ উন্নয়নে অসামন্য অবদান ওই পাঁচ নারী। সমাজের দৃষ্ঠান্তসৃষ্টিকারী নারীরা হলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বিল্লগ্রাম গ্রামের কামরুননেছা, আশোকাঠী গ্রামের অরুনা সাহা, উত্তর বিজয়পুরের দেলোয়ারা বেগম, কালনা হাজীপাড়া গ্রামের আসমা আক্তার ও হরিসোনা গ্রামের রমলা রানী তালুকদার।
স্থানীয় লোকজন, গৌরনদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খালেদা খানমসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে জীবন সংগ্রামে জয়ী পাঁচ নারীর জীবন সংগ্রামের চিত্র। কামরুননেছার পিতার আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকায় ১০ম শ্রেনিতে পড়া অবস্থায় পরিবারের অভিভাবগন বাল্য বিবাহ দেন। স্বামীর আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। স্বামী রেজিষ্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার ৬টি কন্যা সন্তান হয়। সন্তানদের ভরন পোষন, পড়াশুনা স্বামীর আয়ে সংসার চলত না তাই অবসর সময় নিজের সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি অন্যের বাড়িতে কাজ করে বাড়তি অর্থ উপর্যন করে তা দিয়েই মেয়েদের পড়াশুনার জন্য ব্যায় করতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্বামী মারা যান। মৃত্যুর সময় তার ম্বামী কিছুই রেখে যাননি, স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মেয়েদের সাথে পড়াশুনা করে ১৯৭৪ সনে এস,এ,সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। তিনি মা ও শিশু সাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষন নিয়ে একজন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ধার্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০১ ও ২০০২ সনে ৯বম ও ১০ম টিকাদান কর্মসূচীর প্রশিক্ষন গ্রহন করে এলাকার শিশুর সাস্থ্য পরিচর্যা ও ধার্এীর কাজ করে ভালো ভাবেই জীবিকা নির্বাহ করেন। এলাকায় তার যথেষ্ঠ সুনাম রয়েছে। তিনি ১০ শতাংশ জমি কিনে নিজের উপর্জিত অর্থ দিয়ে চৌচলা ঘড় তুলেছেন। এখন সে স্বাবলম্বী। মেয়েদের ও শিক্ষিত করে ৩ মেয়েকে বিবাহ দিয়েছেন। ৪র্থ মেয়ে ডিগ্রী পরিক্ষার্থী, ৫ম মেয়ে গৌরনদী সরকারী কলেজে ডিগ্রীতে পড়ছে ও ছোট মেয়ে বরিশাল পলিটেকনিক কলেজে ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আরেক সংগ্রামী নারী অরুনা সাহা। পিতার সংসারে পড়া লেখার পাশাপাশি সাংসারিক কাজকর্ম করতে হয়েছে। তিনি ১৯৬৭ এস,এস,সি পাশ করেন,১৯৬৯ সনে এইচ,এস,সি পাশ করেন, ¯œাতক পাশ করেন-১৯৭১ সনে। খুলনা টিসার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি করেন। পড়া শুনার পাশা পাশি পিতার অনুপ্রেরনায় সঙ্গীত চর্চা করেন এবং খুলনা বেতারে অডিশেন দিয়ে একজন নিয়মিত সঙ্গীত শিল্পি হিসেবে অর্šÍভ‚ক্ত হয়ে গান পরিবেশন করেন। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ¯œাতক শ্রেনীতে পড়ার সময় ১৯৭১ সনে “অপারেশন সার্চ লাইট” ফরিদপুর থেকে পায়ে হেটে কলেজের অন্যান্য ছাত্র নেতাদের সাথে ভারতে যান, সেখানে স্বাধীন বাংল বেতারের অন্যান্য শিল্পীদের সাথে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে অনুপ্রেরনা দেন। ১৯৭২ সনে তার বিবাহ হয়। বিবাহের সময় তার স্বামী ফরিদপুরের একটি কলেজে প্রভাষক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি গৌরনদীতে (শ^শুর বাড়িতে) স্থায়ী ভাবে থাকেন,১৯৭৪ সনে তিনি গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সেই স্কুলে ৬ বছর চাকুরী করার পর ১৯৮০ সনে পালরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয় যোগদান করেন। দীর্ঘ ৩০ বছর শিক্ষকতা করে বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িত রাখেন। ২০১০ সনে তিনি অবসর গ্রহন করেন। ১৯৭৫ সনে তিনি গৌরনদীতে তার স্বামী মানিক লাল সাহা “কুহুতান” নামে একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সেই সংগীত বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
দেলোয়ারা বেগম গৌরনদী উপজেলার উত্তর পালরদী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি যে সময় জন্ম গ্রহন করেন তখন গ্রামের মেয়েরা ৫ম শ্রেনীর বেশী পড়াশুনা করত না, তিনি মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। স্কুলের শিক্ষক এবং পিতার ঐকান্তিক ইচ্ছায় প্রাথমিক স্তর শেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভর্তি হন এবং দশম শ্রেনীতে পড়া অবস্তায় বিবাহ হয়ে যায়। স¦ামী উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন তার প্রচেষ্টায় তিনি এস,এস,সি,এইচ,এস,সি,পাশ করেন। সন্তানরা একটু বড় হলে তিনি বিএ পাশ করেন । এবং পাশাপাশি সন্তান এবং পরিবারের দিকেও সমান নজর দিতেন।তিনি ৩সন্তানের জননী। বড় ছেলে এস,এস,সি ও এইচ,এস,সি তে ষ্টার মার্ক সহ প্রথম বিভাগ উত্তির্ন হয়, বর্তমানে সেনাবাহিনীতে লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে কর্মরত। সে বি.এস .সি ও এম,এ তেও ১ম শ্রেনী পেয়েছে। মেঝ ছেলে বি,এ,সি ইঞ্জিনিয়ার, জেনারেল ম্যানেজার, নাভানা পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, ঢাকায় কর্মরত। সেও এস,এস,সি ও এইচ,এস,সি তে ষ্টার মার্ক সহ প্রথম বিভাগ উত্তির্ন হয়। মেয়ে বি.এস.এস(অর্নাস) এম.এস.এস অর্থনীতিতে পাশ। বর্তমানে সহকারী শিক্ষক পদে লেঃ সহিদ আনোয়ারা বীর উত্তম গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে কর্মরত।তিনি নিজের পড়াশুনা,চাকুরী,সংসার,স্বামী সন্তানদের দায়িত ¡যথাযথ ভাবে পালন করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজ তারা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এসবই সম্ভব হয়েছে দেলোয়ারা বেগমের অদম্য ইচ্ছার কারনে, সাথে তার স্বামীর সহযোগীতার ও তাকে সাহশ যুগিয়েছে। তিনি একজন সফল জননী । আসমা আকতার এইচ,এস,সি পাশ।পড়া শুনায় ভালো ছিল। ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা করে ব্যাংকে চাকুরী করার। এস.এস.সি ও এইচ.এস.সিতে প্রথম শ্রেনীতে উত্তির্ন হন।পরিবারের পছন্দের দাম দিতে গিয়ে অবস্থাপন্ন অশিক্ষিত বিদেশ ফেরত বেকার ছেলের সাথে বিবাহ হয়। বিয়ের পর বিদেশে নিয়ে যায়। সেখানে তার ২টি সন্তান জন্ম হয়। সেখানে ভালই ছিল, হঠাৎ সন্তান সহ দেশে ফিরে আসে ,আর বিদেশে ফিরে না গিয়ে বাজে কাজ করে বেড়ায় বাধা দিলে বা কিছু বললে গালাগালি, মারধর করে, বাবার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। যাত্রা করে বেড়ায়। যাত্রা দলের নায়িকাকে বিয়ে করে আলাদা সংসার করে থাকছে। সন্তানদের ও কোন খোজ খবর নিচ্ছে না। নিজের পায়ে দাড়ানোর জন্য এখন সংগ্রাম শুরু করছে। এখন কলেজে বি,এ ভর্তি হয়েছে। কম্পিউটার কোর্স করেছে। যুব উন্নয়ন খেকে ৩ মাসের ট্রেনিং দিয়েছে। মায়ের সাথে হাস মুরগি, গরু পালছে এ দিয়েই সন্তানদের মানুষ করা জন্য আবার নতুন করে জীবন শুরু করছে। ব্রাকের সাথে পল্লী সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে বিভিন্ন নারী উন্নয়ন মূলক কাজে সম্পৃক্ত করে সাবলম্বি হবার চেষ্টা করছে। সে এখন তার সকল নির্যাতনের অভিশাপ মুছে ফেলে নতুন উদ্দমে জীবন শুরু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রমলা রানী তালুকদার ৮ ভাই বোনের সংসার। বাবা ছিলো সামান্য কৃষক,বাবার অর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। বাবার একার আয়ে সংসার ,৮ ভাইবোনদের পড়াশুনা করানো সম্ভব ছিলো না। তাই ৫ম শ্যেনীতে পড়া অবস্থায় বিবাহ হয়।তার ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাড়াবো কিন্তু বিবাহের পর আর পড়াশুনা হয় নাই।স্বামী শিক্ষিত ছিলো ,তার ইচ্ছাও ছিলো তাকে পড়ালেখা শেখানোর কিন্তু সংসারের কারনে সম্ভব হয়ে উঠেনি। বিবাহের কয়েক বছরের মধ্যে স্বামী মারা যায়।স্বামী মারা যাবার পর সংসারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। নিজের ছেলে মেয়ে না থাকায় বোনের মেয়েকে এনে পড়াশুনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করার ইচ্ছা আছে। নিজে শিক্ষিত হতে পারেনি বলে মনে আফসোষ ছিলো তাই সে তার লেখা পড়ার অভাবটা বোনের মেয়েকে দিয়ে পুরন করতে চাচ্ছে। সে ব্রাকের সহযোগীতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহন করেছে । ব্রাকের পল্লী সমাজের সভানেত্রী, এলাকার মহিলাদের নিয়ে দল গঠন করে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করছে। দলের মহিলা সদস্যদের সহযোগীতায় মন্দির নির্মান করেছে।নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার রক্ষার্থে কাজ করছে।বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে মানব বন্ধন কর্মসূচী করে ঐ এলাকা বাল্য বিবাহ মূক্ত এলাকা ঘোষনা করছে। সে একজন ধাত্রী।সে সমাজের নারীদের সকল ব্যাপারে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন।তিনি নিজেকে একজন সমাজ সমাজকর্মী হিসেবে মনে করেন।