গৌরনদী
উজিরপুরের হারতায় দুর্ধর্ষ ডাকাতি ॥ ডাকাত পুলিশ গুলি বিনিময়, ইনচার্জসহ ১৮ পুলিশ প্রত্যাহার ॥ পুলিশের বিরুদ্ধে ডাকাতিতে সহায়তা করার অভিযোগ
জহুরুল ইসলাম জহির, হারতা, উজিরপুর থেকে ফিরে
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লি হারতা ইউনিয়নে দক্ষিনাঞ্চলের বৃহৎ ব্যবসায়ী বন্দর হারতা বন্দরের উত্তরপাড়ে ১৭টি মাছের আরতে মঙ্গলবার রাতে দুধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় উজিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে ডাকাতি করে পালানোর সময় সন্ধ্যা নদীতে পুলিশের সঙ্গে ডাকাতের গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। দায়িত্বে গাফলতির অভিযোগে হারতা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জসহ ১৮ পুলিশে ওই রাতেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ডাকাতির ঘটনায় হারতা পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ জড়িত বলে স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ী সরাসরি অভিযোগ করেন।
উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সরোয়ার জানান, ডাকাতির ঘটনায় ওই দিন রাতেই নিহত মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সোহরাব বেপারীর পুত্র মো. খোকন বেপারী বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জনকে আসামি করে ডাকাতিতে হত্যা (৩৯৬ধারা) একটি মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়া দায়িত্বে গাফলতি ও অবহেলার অভিযোগে মঙ্গলবার গভীর রাতে হারতা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক(এস,আই) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ১৮ কনষ্টবলকে বরিশাল পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। উপ-পরিদর্শক (এস.আই) মো. দেলোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এস,আই দেলোয়ার হোসেন ১৮ জন কনষ্টবল নিয়ে রাতেই যোগদানের কথা স্বীকার করেন। বাবুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সালাম জানান, ডাকাতি শেষে পালানোর সংবাদ পেয়ে রাত ৭টার দিকে একদল পুলিশ নিয়ে ট্রলারযোগে ডাকাতদলকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়। এসময় সন্ধ্যা নদীর বাবুগঞ্জ মোল্লার খাল এলাকায় ডাকাতদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পুলিশ ১৫ রাউ- গুলি ছুড়ে। ট্রালারে চেয়ে স্পীডবোর্ডের গতি বেশী থাকায় ডাকাতরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
হারতা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারন সম্পাদক নরেন্দ্র নাথ বাড়ৈ (৫০) জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৪/৫ ডাকাত স্পীডবোর্ডে থেকে হারতা বন্দর উত্তর পাড়ের ঘাটলায় নেমে ৪/৫টি বোমার বিস্ফোরন ঘটনানো সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য বাজারের উত্তর মাথায় পূর্বে থেকে অপেক্ষেমান ৫ ডাকাত কয়েকটি বোমার বিস্ফোরন ঘটায়। এসময় বন্দরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি হয়। তারা প্রান রক্ষায় দিকবিদিগ ছোটাছুটি করতে থাকে। ডাকাতরা কয়েক রাউ- ফাকা গুলি ছুড়ে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে। ডাকাতরা ১৭টি আড়তে হামলা চালেিয় ব্যবসায়ীদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করে কোটি টাকারও বেশী লুট করে নিয়ে গেছে। ডাকাতের হামলায় মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিসহ মো. সোহরাব বেপারী নিহত । উজিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক(এস,আই) মো. জসিম উদ্দিন জানান, পুলিশের হিসেব অনুযায়ী ডাকাতদের লুট করে নেওয়া টাকার পরিমান ৬৭ লাখ টাকা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ডাকাতের হামলায় নুর আলম(৪০), আকবর(৪৫), আরিফ হোসেন(২২), সজল ম-ল(২৪), উত্তম বাড়ৈ(৪৮)নজরুল ইসলাম(২২)ইউনুস আকন(৩৫), বোমার আঘাতে অঞ্জনা রানী(৩০), ব্যবসায়ী মিলনের স্ত্রী মৌসুমি(২৭) তার কন্যা মারিয়া(৩), সমিরন রায় (৩০) শুভ( বৌদ্ধ(৪২) সুশান্ত (৪০)সহ ২৫ জন আহত হয়। উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাঃ পলাশ সরকার জানান, গুরুতর আহত সমিরন রায় ও সুশান্ত ও শুভকে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিহত সোহরাব বেপারীর আড়তের ক্যাসিয়ার নুর আলম(৪০) বলেন, মাগরিবের নামজের পরপর ডাকাতরা মৎস্য বন্দরের দুই দিক থেকে বৃষ্টির মত বোমার বিস্ফোরন ও ফাকা গুলি করে ডাকাতরা। চার ডাকাত আমার আড়তে ঢুকে কর্মচারী ও ক্রেতা বিক্রেতাদের শাপল দিয়ে এলোপাতারি পিটাতে থাকে। আমার মালিক সোহরাব বেপারী (৬৫)কে শাপল দিয়ে ৪/৫টি আঘাত করলে কিছুক্ষন পর সে অসুস্থ্য হয়ে মারা যান। ডাকাতরা আমার ক্যাস থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা বিক্রেতাদের কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী অঞ্জনা রানী বাড়ৈ(৩০) প্রেমানন্দ ম-ল(৪৮) বলেন, স্পীডবোর্ডে আসা শসস্ত্র তিন ডাকাত ঘাটে নামেন। একজনের হাতে বড় বালতি ভর্তি বোমা ছিল। এক ডাকাত ফাকা গুলি ছুড়ে ও বালতি হাতে ডাকাত বোমা ফাটাতে ফাটাতে সামনে চলে যান। সাগর মৎস্য আড়তের কর্মচারী বিধানহালদার(৩৪) জানান, ডাকাতরা তাদের আড়তে ঢুকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও লোহার পাইপ দিয়ে পিটিয়ে জখম করে ১৩ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে।
বন্দরের বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী উত্তম বাড়ৈ, সালাম মোল্লা, সুভাষ রায়, নরেন্দ্র নাথ বাড়ৈসহ শতাধিক ব্যবসায়ী তীব্র ক্ষেভোর সঙ্গে বলেন, ডাকাতির ঘটনায় হারতা পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ জড়িত ছিল। নতুবা কোন ভাবেই ডাকাতি করে ডাকাতরা পালাতে পারত না। বন্দরের ব্যবসায়ী হারতা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক অমল মল্লিক(৪৫) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাম্প ইনচার্জকে ডাকাত প্রতেরোধের জন্য অনুরোধ জানাই। পুলিশ এগিয়ে আসলে ২/৩ হাজার ব্যবসায়ী তাদের সঙ্গে ডাকাত প্রতিরোধ করত। পুলিমকে ফাকা গুলি করতে অনুরোধ করেছি কিন্তু কোন কর্নপাত করেননি। ব্যবসায়ী ছত্তার হাওলাদার(৫০) সুবল ম-ল(৫৫) অনেক ব্যবসায়ী বলেন, পুলিশের সহযোগীতা না থাকলে এখানে ডাকাতি করা এতো সহজ হত না। কারন ক্যাম্প থেকে ডাকাতির স্থলে আসতে নৌকায় মাত্র ৩/৪ মিনিট লাগে এবং ট্রলারে আসতে ২মিনিট লাগে। ডাকাতরা ২৫/৩০ মিনিট ধরে ডাকাতি করে । এসময় পুলিশ নিশ্চুপ ছিল। হারতা খেয়া খাটের মাঝি হারতা গ্রামের দেলোয়ার হাওলাদারের পুত্র সুমন হাওলাদার(৩০) বলেন, ডাকাতরা পূর্ব দিক থেকে এসে ২০/২৫ মিনিট সময় নিয়ে ডাকাতি করে যাওয়ার সময় ডাকাতের স্পীডবোর্ড দক্ষিন পাড়ের পুলিশ ক্যাম্পের ৩০ ফটু দুরে কূল ঘেসে চলে যায়। পুলিশ ইচ্ছ করলে গুলি করে বোর্ড ডুবিয়ে দিতে পারত কিন্তু তারা আসেনি। হারতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হরেন রায় ডাকাতিতে হারতা পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ জড়িত সরাসরি এ অভিযোগ করে বলেন, হারতা বন্দরের ডাকাতিতে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা আছে। তা না হলে সামান্যতম দুরত্বে থাকা পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ কেন নিরব ছিল। কেন ডাকাতি প্রতিরোধে আগাইয়া আসেননি, ফাকা গুলি করেননি। দায়িত্বে অবহেলা ও ডাকাতদের সহযোগীতার অভিযোগ অস্বীকার করে এস,আই মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নদী পার হওয়ার বাহন না থাকায় ওপারে যেতে পারি নাই। তার এ বক্তব্য প্রত্যখান করে ব্যবসায়ীরা ও খেয়া পাড়াপাড়ের নৌকার কয়েকজন মাঝি বলেন, ওই সময় দুই পাড়েই অসংখ্য নৌকা ও ট্রালার ছিল আমরা পুলশকে নিয়ে আসার জন্য ক্যাম্পে গেলেও তারা আসেননি। ডাকাতির সময় হারতা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ একটি জিডি করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, ডাকাতির খবর পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু ট্রলার না পাওয়ায় যেতে পারি নাই। ডাকাতদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করতে ফাকা গুলি ছুড়ি। এলাকাবাসী তার জিডিকে মিথ্যাচার বলেছে।
উল্লেখ্য ২০১৪ সালে ১৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে হারতা জেলে পাড়ায় আলোচিত ডাকাতিতে হারতা পুলিশ ক্যাম্প জড়িত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।