গৌরনদী
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিদ ও গবেষক এম. আর মাহবুব এর স্মরনে
আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ন তার সঠিক ইতিহাস সংরক্ষন করা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ন। ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার ইতিহাস একমাত্র আমরা বাঙালীরাই গড়েছি। ভাষাশহীদদের জীবনের বিনিময়ে ও ভাষাসংগ্রামীদের অবদানে আমরা পেয়েছি ‘অমর একুশে’, পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা আন্দোলনেরই পথ ধরেই আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা ও লাল সবুজের পতাকা। আর এ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বদরীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক গৌরনদীর কৃতি সন্তান ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব। ভাষা আন্দোলনে সকল শহিদ ও ভাষা সৈনিকের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষন ও গবেষনা নিয়ে কাজ করেছেন এম. আর মাহবুব। এম. আর মাহবুব ছিলেন ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব এর কাছের জন। আর ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব এর স্নেহধন্য হিসেবে আমার সাথে এম. আর মাহবুব এর পরিচয়। পরিচয়য়ে পর থেকে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎ এর মধ্য গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়। মাঝে মাঝে বই বিনিময়। মাহবুব ভাই ছিলেন একজন ভাল মনের মানুষ। মাহবুব ভাই নেশা ছিল ভাষা আন্দোলনের তথ্য অনুসন্ধান। ভাষাশহীদদের জীবনের বিনিময়ে ও ভাষাসংগ্রামীদের অবদান ও আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহে এ প্রজন্মের একজন তরুণ গবেষক ও সংগ্রাহক দীর্ঘদিন ধরে নীরবে নিভৃতে কাজ করেছেন। সংগ্রহ করেছেন অনেক দুর্লভ ও অপ্রকাশিত তথ্য ভাণ্ডার এবং স্মৃতিস্মারক। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক, সংগ্রাহক ও লেখকদের তালিকায় সগৌরবে যুক্ত হয়েছে একটি নাম। তিনি এম আর মাহবুব। এ যাবৎকালে তাঁর রচনা ও সম্পদনায় প্রকাশিত হয়েছে ৫৬টি ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসংগ্রামী জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ।সংবাদ পত্রে ভাষা আন্দোলন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬,প্রথম শহীদ মিনার, একুশে যত প্রথম, একুশের স্মারক গ্রন্থ, যারা অমর ভাষা সংগ্রামী ওভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র(১খন্ড ২য় খন্ড,৩য় খন্ড) অন্যতম। আজ ২১ এপ্রিল এম. আর মাহবুব ভাইর মৃত্যু বাষির্কী। এই মহান মানুষটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এ লেখা।
এই মানুষটি সম্পর্কে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা জায়, শুরুটা ১৯৮৭ সাল থেকে। সেই থেকে ২০১৮ সাল। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়োজিত ছিলেন এই কর্মে। ভাষাসংগ্রামীদের জীবনী ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিষয়ক পঞ্চাশের অধিক এবং অন্যান্য বিষয়ে আরো বেশ কিছু গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। ১৯৮৭ সালে গবেষক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে গঠিত হয় ভাষা আন্দোলন পরিষদ। ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ চিহ্নিতকরণ ও ফলক স্থাপন করে এই সংগঠনটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। এম আর মাহবুব জাতীয় ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞে একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক এম. এ. বার্ণিকের নেতৃত্বে গঠিত হয় ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম। এই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই একজন সদস্য ও কর্মী হিসেবে তিনি জড়িত ছিলেন, পরবর্তীকালে সদস্য সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালের ৩১ আগস্ট গঠন করা হয় ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদ। এই পরিষদের মনোনীত সহসভাপতি ছিলেন এম আর মাহবুব। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চা ও স্মৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন ছাড়াও এম আর মাহবুব অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন-সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে গঠিত কমিটির সঙ্গেও কাজ করেছেন। ভাষা আন্দোলন পরিষদ, ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম, ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদ, ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর এবং একুশে চেতনা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গবেষণা কর্মের প্রয়োজনে দেশের পথে প্রান্তরে ঘুরেছেন, শত ভাষাসৈনিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, লাইব্রেরি-আর্কাইভে বছরের পর বছর বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা ঘেঁটেছেন- ‘যেখানে দেখিবে ছাই, কুড়াইয়া লইবে তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’ কবির এই বাণীকে নিজের জীবনে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের তথ্য-উপাত্ত ও ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিস্মারকের সন্ধানে বিরামহীন, পরিব্রাজকের মতো ছুটেছেন। উদ্দেশ্য একটাই- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে বের করা। এই মহান ও ঐতিহাসিক আন্দোলনের ইতিহাসচর্চা, গবেষণা ও স্মৃতি রক্ষায় যে কয়েকজন গবেষক নিরন্তর কাজ করে গেছেন এম আর মাহবুব তাদের মধ্যে অন্যতম। কোনো রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এগিয়ে গিয়েছেন তিনি।
এম আর মাহবুব যখন ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ শুরু করেন, তখন তিনি ছিলেন বয়সে নবীন। ভাষা আন্দোলন ও একুশের ঘটনা তার জন্মের বহু পূর্বে। তাই তথ্য সংগ্রহের জন্য তাকে বহু শ্রম ও সময় দিতে হয়েছে। তারুণ্যের উন্মাদনার সোনালি সময়কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন একটি মহৎ ও জাতীয় প্রয়োজনে। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক মূল্যবান ও দুর্লভ দলিলপত্র সংগ্রহ করেছেন। ভাষাসৈনিকদের ‘জীবন-কথা ও স্মৃতিচারণ’ সংগ্রহ করেছেন, এদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত। সংগ্রহ করেছেন ভাষা আন্দোলনের অনেক দুর্লভ ও অপ্রকাশিত ছবি। ভাষাসৈনিকদের হস্তলিপি, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, স্মৃতিস্মারক, ডায়েরি, চিঠিপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এমন উপেক্ষিত ও বিস্মৃত ভাষাসৈনিকদের খুঁজে বের করেছেন। উদ্ধার করেছেন তাদের গৌরবদীপ্ত অবদানের স্মৃতিকথা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণায় এম আর মাহবুব সব সংকীর্ণতা পরিহার করে কাজ করেছেন। তিনি ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গ্রন্থ রচনা ও গবেষণাকর্মে ১৯৪৭ সালের সূচনা পর্বকে যেমন যথাযথভাবে স্থান দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকেও সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। এম আর মাহবুব কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি, পন্থি বা কোনো মতের পক্ষাবলম্বন না করে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস নির্মাণের স্বার্থে উক্ত ইতিহাসের প্রায় সব সৈনিক বা কর্মীর কাছে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণায় এম আর মাহবুবের একটি বড় বিশেষত্ব হলো সেই ’৮৭ সাল থেকে একটি কাজকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। কাজের ফাঁকে, অবসরে একটিই চিন্তা, একটিই কাজ সেটি ভাষা আন্দোলনবিষয়ক গবেষণা। কর্মজীবনে তার পেশা, কর্মস্থল পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন হয়নি শুধু এই বিষয়টি। সারাক্ষণ তার চিন্তাচেতনার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ।
এম আর মাহবুব ভাষাবিদ বা ভাষাবিজ্ঞানী নন, বাংলা সাহিত্য বা ইতিহাসের ছাত্রও নন। শুধু একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের ছাত্র হয়েও তিনি ভাষা আন্দোলনের গবেষণা ও ইতিহাস লেখার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। একুশের ইতিহাসের অনেক ঘটনা আজও আমাদের দৃষ্টির বাইরে। সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও একুশের চেতনা আজও যথাযথভাবে আমাদের জাতীয় জীবনে বাস্তবায়িত হয়নি। এম আর মাহবুব খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে দীর্ঘদিন ধরে এই একটি বিষয় নিয়ে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য গবেষণা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণাই এম আর মাহবুবের বিশেষত্ব। এ বিষয়ে তিনি সর্বাধিক উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত। তবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও তিনি একজন সংগ্রাহক ও গবেষক। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া’ নরসিংদী জেলার সমন্বয়কারী হিসেবেও কাজ করেছিলেন। মাহবুব ভাইয়ের জীবদ্দশায় প্রায় প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী জাতীয় দৈনিকে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এসব নিয়েও বই প্রকাশিত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এম আর মাহবুব লিখিত প্রবন্ধগুলোর একই বিষয় আর সেটি হলো ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষাসংগ্রামী বিষয়ক। অগ্রন্থিত শতাধিক প্রবন্ধের মধ্যে অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। এছাড়া সাপ্তাহিক ও বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়ও বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এম আর মাহবুব বেশ কিছু পত্রিকা সম্পাদনার কাজে জড়িত ছিলেন। এম আর মাহবুব নিউরোলজি ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এবং ‘নিউরন’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কয়েক বছর। পত্রিকা সম্পাদনা, লেখা সংগ্রহ এবং এসব অনুষ্ঠানাদির সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকার কারণে এ সময়ে এম আর মাহবুব দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সুধীজনদের একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেন।
২০১১ সালে প্রখ্যাত গ্রন্থবিজ্ঞানী, কবি, লেখক, গবেষক মোহাম্মদ সা’দাত আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মননশীল ও মুক্তচিন্তার মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সাগরদি’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ওই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এম আর মাহবুব। ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের বার্ষিক প্রকাশনা ‘ভাষা’ এবং বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদের মুখপত্র ‘উর্মি’র সম্পাদক হিসেবে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। এম আর মাহবুব শুধু একজন লেখক, গবেষক ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ সংগঠকও বটে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণ, গবেষণা ও ইতিহাসচর্চা বিষয়ক সংগঠন ছাড়াও তিনি আরো বেশ কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক এম আর মাহবুব ১৫ অক্টোবর জন্ম গ্রহন করেন। এবং ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল মৃত্যুবরণ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে চলে যান। আজ তার মৃত্যু বার্ষিকীতে আমরা তাঁর সৃষ্টিকর্ম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান কেরেন। পাশাপাশি তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করবে এটাই আজকের প্রত্যশা । লেখকঃ জহুরুল ইসলাম জহির, প্যানেল আহবায়ক ও সাবেক সভাপতি, গৌরনদী প্রেসক্লাব, সাবেক চেয়ারম্যান গৌরনদী বিআরডিবি ও সাধারন সম্পাদক, ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন।