গৌরনদী
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স \ যেখানে চিকিৎসক ও সেবা নিতে আসা রোগী থাকেন আতংকে
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেখানে এসে চিকিৎসক ও রোগীদের জখম আতংকে থাকতে হয় । উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে প্রায়ই আহত হন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও সেবা নিতে সাধারন মানুষ। জীবনের ঝুকি নিয়েই চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা কার্যক্রম। এ ছাড়া চিকিৎসক সংকট, চিকিৎসা সেবার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকাসহ নানাবিধ কারনে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা। জরুরী ভিত্তিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবনের কার্যক্রম স্থান্তরিত না কারলে ভয়াবহ ট্রাজেটির ঘটনা ঘটার আশংকা রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন, সেবা নিতে আসা রোগী, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালের প্রত্যন্ত পল্লি বা বিল হিসেবে খ্যাত উজিরপুর উপজেলার প্রায় তিন লক্ষাধিক জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে ১৯৭৪ সালে একটি ভবন নির্মান করে উজিরপুর সদরে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরবর্তিতে ২০১০ সালে তা সম্প্রসারিত করে ৫১ শয্যার উন্নীত করা হয়। কিন্তু অবকাঠামোগত ভাবে নতুন করে ভবন নির্মান করা হয়নি। গত ৫০ বছরে ভবনটির বড় ধরনের কোন সংস্কার না হওয়ায় এবং নতুন কোন ভবন নির্মান না হওয়ায় বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনটি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। মৌখিকভাবে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হলেও জীবনের ঝুকি নিয়ে সেখানেই চিকিৎসকরা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন এবং সেবা নিচ্ছেন সাধারন মানুষ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১টি চিকিৎসক পদ থাকলেও চিকিৎসক আছেন ১২জন। তার মধ্যে গাইনী বিশেষজ্ঞসহ দুজন চিকিৎসক অন্যাত্র সংযুক্ত রয়েছে। ফলে এ উপজেলার বিশাল জনগোষ্ঠীকে ৮জন চিকিৎসক দিয়ে সেবা প্রদান খুবই কষ্টকর। পাঁচটি নবসৃষ্ট পদ থাকলেও ওই পদে এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মী সংকটের কারনে হাসপাতালের পরিবেশ প্রায়ই নোংরা থাকে। দুইজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে গোটা কমপ্লেক্সে সামলানো কষ্টকর। উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ শওকত আলী বলেন, চিকিৎসক সংকট, চিকিৎসা সেবার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকাসহ নানাবিধ কারনে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে । তাছাড়া সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে হাসপাতাল ভবনের। এটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করার পরেও কোন জায়গা না থাকায় পরিত্যক্ত ভবনেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিতে ও নিতে হয়। রোগীসহ আমরা সব সময় আতংকে থাকি না জানি কখন ভবনের বিম ও ছাদের পলেস্তার খসে পরে রক্তাক্ত জখম হতে হয়। প্রায়ই চিকিৎসক ও রোগী আহত হয়। তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি সময়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল ইসলাম (৪০) ও হারবাল এ্যাসিস্টেন্ট মোঃ হান্নান (৪৫) নিজ কক্ষে বসেই কাজ করছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবনের ছাদের পলেস্তারা বিকট শব্দে খসে তাদের মাথায় শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তাক্ত জখম হন। আহতদের ডাক চিৎকার ও কান্নাকাটির শব্দ শুনে অন্যান্য সহকর্মীরা তাদের উদ্ধার করে জরুরী বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। হাসপাতালের ভবনটি অতী পুরানো হওয়ায় মাঝে মধ্যে ওয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পরে রোগীসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আহত হন। বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বার বার অবহিত করা হয়েছে। এবং উপজেলা পরিষদের মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় উপস্থাপন করা সত্বেও এখনো কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার কিংবা নতুন ভবন নির্মান করা না হলে প্রানহানির আশংকা রয়েছে। আমাকে প্রশাসনিক কাজে ব্যবস্থ থাকতে হয়। প্রতিদিন হাসপাতালের আউটডোরে দৈনিক তিনশ থেকে চারশ রোগী সেবা নিতে আসে। ইনডোরে সবসময় ৬০/৭০ জনেরও বেশি রোগী থাকে। চিকিৎসক সংকটের কারনে এসব রোগীদের স্বাভাবিক সেবা প্রদান অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবনের পিলার (কলম) গুলোর রড ফুলে ফেটে গেছে। অধিকাংশ কলমের ঢালাই ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে রড বের হয়ে আছে। কোন কোন পিলার ভেঙ্গে নুয়ে পড়েছে। ছাদের পলেস্তার খসে খসে পড়ছে। কোথাও কোথাও ছাদে ফাটল দেখা গেছে। ছাদ থেকে বৈদ্যুতিক পাখাসহ পলেস্তার খসে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা এড়াতে ছাদের বৈদ্যুতিক পাখাগুলো খুলে নেয়া হয়েছে। ফলে প্রচন্ড গরমে রোগীদের নাভিস্বাস। ৩১ শয্যার পুরনো ভবনে মহিলা রোগীদের জন্য নির্ধারিত। ভবনটি খুবই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। রোগী এবং চিকিৎসকের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই। আগত রোগী বেডের সঙ্কট থাকায় অনেকেই মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ২০ শয্যার ভবনে পুরুষ রোগীদের জন্য। নির্দারন করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে একই চিত্র। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. রাখাল বিশ্বাস জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারিদের আবাসিক ভবনগুলোও খুবই জরাজীর্ণ এবং মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং বসবাস অযোগ্য। পানি, বিদ্যুৎ সঙ্কটসহ ভবনে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তারপরেও সেখানে বসবাস করতে হয়। ভর্তি রোগী সাহানার আক্তার (৪৫) বলেন, এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আাসা আর আরেক মৃত্যুর ঝুকিতে থাকা একই কথা। ছাদের পলেস্তার খসে বিছানায় পড়ে-খাবারে পরে, আবার রোগীর শরীরেও জখম হয়। সব সময় আতংকে থাকতে হয় কখন জানি পলেস্তার খসে পড়ে রক্তাক্ত জখম হতে হয়। আউটডোরে সেবা নিতে রোগী মোতালেব হোসেন (৫০), আলিমন বিবি (৬০)সহ অনেকেই বলেন, হাসপতালে ডাক্তার এতই কম যে, বেইন্নাকালে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আইলে সন্ধ্যাকালে বাড়ি ফিরতে হয়। হেই গ্রাম থেকে আইয়া মোরা অনেকই ডাক্তার না দেহাইয়া বাড়ি ফিররা যাই।
বরিশাল স্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, অতি সম্প্রতি সময়ে উজিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ মনিরুজ্জামান মোল্লা। তিনি ভবনের খারাপ অবস্থা দেখে নতুন ভবনের প্রকল্প তৈরী করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়ার পরে ভবন পূর্ননিমানের প্রকল্প তৈরী করে তা অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরন করেছি। বরিশাল সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান বলেন, দ্রæত বিষয়টি সমাধান করার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে।