গৌরনদী
বিশ বছর পর বাবা-মাকে ফিরে পেল বেবী
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা থেকে বিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কন্যা শিশু রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মেয়ে বেবী আক্তার বাবা-মাকে ফিরে পেলেন। বাবা-মাও ফিরে পেলেন কন্যা, জামাতা ও দুই নাতি নাতনিসহ চার স্বজনকে। বিশ বছর পরে একে অপরকে ফিরে পেয়ে আনন্দে অশ্রæসিক্ত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সন্তান মা বাবাসহ সকলেই।
বেবীর আক্তারের বাবা রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের রফিজ মন্ডল বলেনন, আমি হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান, নিজেও একজন দিনমজুর । কাজ করতে পারলে খাওন জুটত, নয়তো পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হত। এ অবস্থায় স্ত্রী তিন কন্যা এক পুত্রসহ ৬ জনের সংসার চালানো আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০০২ সালের প্রথম দিকে অভাবের তাড়নায় বড় মেয়ে ৯ বছরের বেবী আক্তারকে একই গ্রামের প্রতিবেশী কামাল হোসেন সোহেলের ঢাকা মিরপুরের বাড়িতে গৃহকর্মির কাজে দেই। কামাল মেয়ে বেবীকে ঢাকায় এনে তার বাসায় গৃহকর্মির কাজ করান। মেয়ে বেবী ছোট খাট ভুল করলে বিভিন্ন সময় নানান অজুহাতে কামাল ও তার স্ত্রী বেবীকে অমানবিক নির্যাতন করত। মেয়ে একাধিকবার তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমার সাথে কান্নাকাটি করেছিল। কিন্তু অভাবের কথা ভেবে আমি মেয়েকে বাড়িতে নেননি। এক সময় কামাল হোসেন মেয়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। একদিন কামাল খবর পাঠান আপনার মেয়ে বেবী কাউকে কিছু না বলে বাড়ি চলে গেছে। সেই থেকে মেয়ে বেবী হারিয়ে যায়। তখন আমি মেয়ে বেবী হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্গাপুর থানায় কামাল হোসেন সোহেলের নামে ডায়রী করেছি। পুলিশ ও আমরা একাধিক স্থানে খুঁজেও বেবীর সন্ধান পাইনি।
হারিয়ে যাওয়া শিশু কন্যা বর্তমানে দুই সন্তানের জননী বেবী আক্তার (২৯) জানান, বাবা আমাকে কাজে দেয়ার পরে কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী আমাকে খুবই মারধর করত, প্রায়ই অমানবিক নির্যাতন চালাত। সহ্য করতে না পেরে আমি বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাবাকে অনুরোধ করেছি কিন্তু বাবা আমাকে নেয়নি। ১০ মাসের সময় আমাকে কামাল সাহেব ও তার স্ত্রী বেদমভাবে মারধর করে সহ্য করতে না পেরে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই এবং মিরপুরের একটি রাস্তায় বসে কান্নাকাটি করছিলাম। এ সময় পথচারি শাহানুর বেগম আমার কাছে কান্নার কারন জানতে চান। সব শুনে তিনি আমাকে বরিশালের আগৈলঝাড়া নিয়ে আসেন। ওই সময় আমি আমার বাড়ি জেলা ও উপজেলার নাম বলতে পারলেও গ্রামের নাম বলতে পারিনি।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জসিম সরদার বলেন, ২০০২ সালে আমার মা শাহানুর বেগম ঢাকার এক আত্মীয়র বাসায় বিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তখন মিরপুরের রাস্তার পাশে কান্না করতে দেখে আমার মা বেবীর কাছে এগিয়ে গিয়ে কান্নার কারন জানতে চাইলে মাকে জড়িয়ে ধরে বেবী সব ঘটনা খুলে বলে। এ সময় মা বেবীর কাছে তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে বেবী শুধু তার নাম এবং বাড়ির জেলা উপজেলার নাম কথা বলতে পারলেও আর কিছু বলতে পারেনি। তখন আমার মা বেবীকে আমাদের গ্রামের বাড়ি আগৈলঝাড়ার কালুপাড়া গ্রামে নিয়ে আসে। সেই থেকে বেবী আমাদের পরিবারের সন্তান হিসেবে বড় হন ও লেখা পড়া করেন। এমনকি বেবীর জাতীয় পরিচয়পত্রেও আমার বাবা মার নাম দেয়া হয়। আমরা আপন ৪ ভাই, ২ বোন এবং পরে বেবী আমাদের ছোট বোন হিসেবে ৩ বোনের মর্যাদা পায়। আমার বড় দুই বোনকে বিয়ে দেয়ার সময় কোন ভাল অনুষ্ঠান করতে না পারলেও ছোট বোন বেবীকে ২০১৪ সালে অনেক বড় অনুষ্ঠান করে উপজেলার নগরবাড়ি গ্রামের ব্যবসায়ী সোহেল ফকিরের সাথে বিয়ে দেন। সোহেল ও বেবীর সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
বেবী আক্তার আরও বলেন, আমার ছেলে মেয়ের গৃহ শিক্ষক আগৈলঝাড়ার নগরবাড়ি গ্রামের শাহাদাৎ খলিফার স্ত্রী পারভীন বেগমকে আমার জীবনের ঘটনা খুলে বলি। পরে পারভিন ম্যাডাম তার কলেজ জীবনের এক সহপাঠি রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলামকে আমার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং বর্তমান অবস্থানের কথা জানান। ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বিষয়টি দুর্গাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ হোসেনের ভাই শহিদুল ইসলামকে জানান। পরবর্তিতে শহিদুল তার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান লতিফকে জানান। চেয়ারম্যান দুর্গাপুর গ্রামের রফিজ মন্ডল খুজে বের করে মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার জিডির সূত্র ধরে বেবীকে খুজে পান। বাবা মা বেবীর সাথে ফোনে কথা হলে নিশ্চিত হয় বেবীই তাদের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। গত বৃহস্পতিবার বাবা রফিজ মন্ডল ও মা সুফিয়া বেগম মেয়ে বেবীর স্বামীর বাড়ি আগৈলঝাড়ায় পৌছেন। মেয়েকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত মা সুফিয়া বেগম বলেন, ২০ বছর ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মেয়েকে পাইনি। ২০ বছর পর মেয়েকে ফিরে পাবেন এটা ভাবতেও পারিনি। মেয়েকে খুঁজে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। বেবী আক্তার বলেন, কোনো দিন ভাবতেও পারিনি, বাবা-মাকে আবার ফিরে পাবো। আমার একটাই চাওয়া ছিল জীবনে মা-বাবাকে যেন একবার হলেও দেখতে পারি। আল্লাহর দরবারে লাখ শুকরিয়া তিনি বাবা-মাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।